মোহাদির গ্রামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অধিকাংশ মানুষের উপকার হলেও কিছু লোকের ক্ষতি হতে শুরু হলো। যেমন ল্যাটা লিয়াকত। এই লোকটি সবার সাথেই কোনো না কোনো বিষয়ে ঝামেলা তৈরি করে। এজ্ন্য তার নামের আগে ল্যাটা উপাধি যুক্ত হয়েছে। তার আরও দুই ভাই রয়েছে। তার এক ভাই খ্যাপা সামসু আর তিন নম্বর ভাই হলো টাকলা আছির। তারা তিন ভাই মিলে সব ধরনের খারাপ কাজ করে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে দর্জি মফিজ। তারা চারজন মোহাদিদের গ্রামের জন্য বিষফোঁড়া। তারা সকল ভালো কাজের জন্য বাধা আর খারাপ কাজের অংশিদার হয়ে দাঁড়ায়।
ল্যাটা লিয়াকতের প্রধান উপার্জনের উৎস হলো সুদের কারবার ও হুমকি-ধামকি দিয়ে মানুষের কাছে থেকে টাকা তোলা। সে উচ্চ সুদে গ্রামের নিরীহ ও গরীব লোকদের টাকা কর্জ দেয়। টাকা আদায় করায় সে খুব দক্ষ। এ ক্ষেত্রে তার সহযোগী খ্যাপা সামসু, টাকলা আছির ও দর্জি মফিজ জোরালো ভাবে সাহায্য করে। তারা কত যে কৃষকের গরু, ছাগল কেড়ে নিয়েছে, জমির ফসল তুলে নিয়ে গিয়েছে, জমি দখল করেছে তা বলে শেষ করা যাবে না। তাদের পৃষ্ঠপোশকতায় আছে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। অন্যায় কাজের জন্য ল্যাটা লিয়াকত কে গ্রামের কোনো মানুষ মন থেকে পছন্দ করে না। তবে ভয়ে তার মুখের উপরে তেমন কেউ কথা বলে না।
একটি অভিনব ও ভিন্ন বিষয় ঘটেছে ল্যাটা লিয়াকতের পরিবারে। তার তিন বউ। তিন সতিনের মধ্যে এত মিল। মনে হয় তারা তিন বান্ধবী। সতিনদের মধ্যে সাধারণত ঝগড়া-ঝাটি থাকে। কিন্তু ল্যাটার তিন বউ সম্পূর্ণ আলাদা। তারা সবাই গরীব ঘরের মেয়ে এবং ধার্মিক। তারা পরিস্থিতির শিকার হয়ে ল্যাটার মতো খারাপ লোকের বউ হয়ে এসেছে। তারা ল্যাটার সংসার করলেও তার খারাপ কাজ কে পছন্দ করে না। এর জন্য অবশ্য ল্যাটার অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়।
মোহাদির প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের উপকার হওয়ার কারণে ল্যাটা লিয়াকতের ব্যবসা একটু খারাপের দিকে। ফলে তার মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা হয়েছে। এজন্য সে মোহাদির প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন রকম ত্রুটি খোঁজার চেষ্টা করছে। কোনো ত্রুটি না পেয়ে মোহাদির প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। রাতের অন্ধকারে সীমানা প্রাচীর টপকিয়ে ল্যাটা লিয়াকতের ভাড়া করা লোকজন মোহাদির প্রতিষ্ঠানের অনেক ক্ষতি করে। মাঝে মাঝে দূর্গন্ধ পদার্থ ফেলে রেখে যায়। বাড়ির নাম ফলক নষ্ট করে। বিভিন্ন কাজে দূর থেকে যে সমস্ত লোকজন মোহাদির প্রতিষ্ঠানে আসে তাদের সাথে অকারণে ঝামেলা তৈরি করে। বিভিন্ন উৎসবে মোহাদির প্রতিষ্ঠানের দিকে মাইক লাগিয়ে উচ্চ শব্দে গান বাজায়। পার্শ্ববর্তী জায়গায় মাটি ফেলে অন্যায়ভাবে বৃষ্টির পানি মোহাদির প্রতিষ্ঠানের দিকে পাঠিয়ে জলাবদ্ধতা তৈরি করে। এসব নিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করলে তিনি উল্টো মোহাদির লোকজনদের দোষারূপ করে।
ল্যাটা লিয়াকত যে কোনো ভাবে মোহাদির প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে চায়। সে গ্রামের মধ্যে ভুল তথ্য ছড়াতে থাকে। সে বলে মোহাদি ভোটে দাঁড়াবে তাই মানুষের উপকার করছে। কিন্তু গ্রামের মানুষ লিয়াকত কে বিশ্বাস করে না। চেয়ারম্যানের কাছে মোহাদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে ধরে। সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলে চেয়ারম্যান কে মোহাদির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। চেয়ারম্যান মোহাদির প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করতে বিভিন্ন অন্যায় পথ অবলম্বন করেন। মোহাদির প্রতিষ্ঠানের পাশের বাড়ির লোককে তিনি টাকার বিনিময়ে তার পক্ষে নিয়ে নেন। সে লোকটি মোহাদির পাঠাগার ঘেঁসে মুরগীর খামার করে। এর উৎকট গন্ধে মানুষ পাঠাগারে পড়তে পারে না। সবাই তাকে অনুরোধ করে মুরগীর খামার অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে। লোকটি কোনো কর্নপাত করে নি। এরপর সব লোক মিলে চেয়ারম্যানের কাছে নালিশ করে। চেয়ারম্যান কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো পাঠাগার অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে বলেন। এতে গ্রামের লোকজন চেয়ারম্যানের উপর অখুশি হয়।
ল্যাটা লিয়াকতের মেজ ভাই খ্যাপা সামসুর মাথা গরম হয়ে যায়। সে যে কী করবে তা ভেবে পায় না। সে রেগে গেলে অন্যের গায়ে হাত না তোলা পর্যন্ত তার রাগ কমে না। গায়ে হাত তোলার কাউকে না পেলে তার সহকারী মফিজকে ফটাফট চড় মারে। মফিজ ব্যাথা পেলেও অভ্যাস হয়ে গেছে। পরে রাগ কমলে সামসু এর বিনিময়ে টাকা দেয়। এই খ্যাপা সামসু চরমভাবে ক্ষেপেছে মোহদির প্রতিষ্ঠানের লোকজনের উপর। এর মধ্যে এক ভ্যান চালকের গায়ে হাত তুলেছে। তাতেও তার রাগ কমেনি। এরপর সে মোহাদির প্রতিষ্ঠানে রাতের অন্ধকারে আগুন লেগে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। কেয়ারটেকার ও গ্রামের কিছু লোকের সচেতনতার কারণে তিন রাত চেষ্টা করে সামসু ব্যর্থ হয়। শেষে খারাপ গন্ধযুক্ত একটি প্যাকেট ছুড়ে মারে।
মোহাদির বাড়িতে ভাড়া থাকা এনজিওর একজন মহিলা কর্মীকে ল্যাটা লিয়াকত বিরক্ত করা শুরু করে। বেশ কয়েকদিন তার পথ রোধ করে বিভিন্ন অবান্তর কথা বলে। তার লোকের মাধ্যমে নির্জন স্থানে দেখা করতে বলে। মেয়েটি ল্যাটার কথা শোনে না। পথে একা পেয়ে লিয়াকত ও কয়েকজন মিলে মেয়েটিকে নির্জাতন করে। এমনকি গায়েও হাত দেয়। মেয়েটি একা থাকায় প্রতিবাদ করতে পারে নি। কোনো রকমে রক্ষা পেয়ে অফিসে ও পরিবারের কাছে শেয়ার করে।
ল্যাটা লিয়াকতের দ্বারা অত্যাচারিত মেয়েটির সহকর্মীরা ও পরিবারের লোকজন প্রথমে ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে নালিশ করে । চেয়ারম্যান ল্যাটা লিয়াকতের পক্ষ নেওয়ায় তিনি অভিযোগটি আমলে নেন নি। পরে বিষয়টি নারী অধিকার আন্দোলন কর্মীদের কাছে পৌঁছায়। তারা ল্যাটা লিয়াকতের বিরুদ্ধে থানায় নারী নির্যাতনের অভিযোগ করে। পুলিশ তদন্তে নামে। পুলিশের তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। আশপাশের কয়েকটি গ্রাম থেকে শত শত লোকের কাছ থেকে লিয়াকত কমপক্ষে দশ কোটি টাকা আমানত নিয়েছে বেশি সুদ দেবে বলে । কিছু লোক টাকা ফিরে পেলেও শতকরা পঁচানব্বই ভাগ মানুষই পাওনাদার রয়েছে। অনেকে আমানতের টাকা ফেরত চেয়েও পায় নি। তারা লিয়াকতের ভয়ে এতদিন কিছু বলে নি। তার উপর লিয়াকতের পক্ষে চেয়ারম্যান থাকায় সে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। এখন পুলিশের সহায়তায় সব ভুক্তভোগী মানুষ মুখ খুলেছে। অবস্থা খারাপ দেখে ল্যাটা লিয়াকত ও তার বাহিনী এলাকা ছেড়ে অন্যত্র গা ঢাকা দিয়েছে। পাওয়ানাদারেরা তার ঘর-বাড়ি, জমি ও দোকানগুলি দখল করে। আর চেয়ারম্যান কিছু জানেন না বলে লিয়াকতের সব ঘটনা অস্বীকার করেন।
চেয়ারম্যান ও ল্যাটা লিয়াকতের অন্যায় কাজ-কর্ম স্থানীয় পত্রিকা খবর প্রচার করে। ফলে সব মানুষের কাছে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়। এরপর চেয়ারম্যানের অনুমোদনহীন ইটের ভাটা ভেঙ্গে দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বড় অংকের জরিমানা করে। এছাড়া তার ফিটনেসবিহীন কয়েকটি ট্রাক আটক করে পুলিশ । ফলে চেয়ারম্যানের অবৈধ সব উপার্জনের সব পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং জনপ্রিয়তা চরমভাবে ঢস নামে। এই সুযোগে কয়েকজন পাওয়াদার তাদের টাকার জন্য চেয়ারম্যানকে চাপ দিতে থাকে। এই বিযয়টি অনেকটা এরকম: “হাতি গর্তে পড়লে চামচিকা এতে লাথি মারে” ।
চেয়ারম্যানের আরও অবৈধ কাজের উৎস পাওয়া যায়। ইউনিয়ন পরিষদে কৃষকদের জন্য আসা সার, বীজ ও কীটনাশক বিতরণ না করে গোপনে বাজারে বিক্রি করেছিলেন। যার কাছে বিক্রি করেছিলেন তিনি হলেন সারের দোকানদার জিসু ডিলার। চেয়ারম্যানের এই বিপদের দিনে জিসুর কর্মচারী ফজা মিয়া ফাঁস করে দেয়। এটা জানাজানি হওয়ার পর গ্রামের কয়েকজন কৃষক উপজেলা অফিসে অভিযোগ দেন। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চেয়ারম্যান ও তার তিন সহযোগির বিরুদ্ধে মামলা হয়।
চেয়ারম্যান ও ল্যাটা লিয়াকতের পতনের পর সাধারণ মানুষের সহায়তায় মোহাদির প্রতিষ্ঠানের বড় বিপদ কেটে যায়। এরপর আগের চেয়ে ভালোভাবে সব কাজ-কর্ম চলতে থাকে।
পরের অধ্যায়: মোহাদি প্লেক্সাস উদ্ভাবন করলো