অন্যকে পরিবর্তন করা খুব কষ্টকর বা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কিন্তু নিজেকে পরিবর্তন করা অনেক সহজ।
মোহাদি নতুন চাকরি শুরু করেছে। এটা তার জীবনের প্রথম চাকরি। চাকরিটা ভালোই। এখানে নতুন কিছু শেখার অনেক সুযোগ রয়েছে। শেখার ব্যাপারে তার আগ্রহও প্রচুর। চাকরিতে যোগদান করার পর প্রশিক্ষণে সে খুব সিরিয়াস ছিল। সে খুব ভালোভাবে প্রশিক্ষণের সব তথ্য আয়ত্ত্ব করেছিল। ফলে সে কোম্পানীর উর্ধতন কর্মকর্তাদের নজরে আসে। প্রশিক্ষণ শেষে মোহাদি যখন কাজ শুরু করেছে, পদে পদে সে বাধা পেয়েছে, যদিও সে উর্ধতনদের প্রতি অনুগত ও নিয়মানুবর্তী ছিল। বিশেষ করে খুব পুরাতন কর্মীরা মোহাদির জন্য বিভিন্নরকম ফাঁদ তৈরি করেছিল।
মোহাদি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছে তার উৎপাদন ইউনিট শহর থেকে বেশ দূরে। আর তার দায়িত্ব পড়েছিলো ঐ ইউনিটে। ফলে প্রথম মাসে তার থাকার ব্যবস্থা হয় প্রতিষ্ঠানের রেস্ট হাউজে । রেস্ট হাউজটি খুব সাজানো-গোছানো। এটি কারখানার সাথে লাগানো। এর এক দিকে কারখানার দেওয়াল আর বাকি তিন দিকে বাগান। বাগানে অনেক ফুল ও ফলের গাছ রয়েছে। এর কাছেই প্রহরীদের কামরা। সুতরাং নিরাপত্তাও বেশ ভালো। রেস্ট হাউজটি মূলত বিদেশী কোন ক্রেতা বা কোম্পানীর উর্ধতন কর্মকর্তাদের জন্য তৈরি করা। কাজ করতে করতে ক্লান্ত হলে তাঁরা বিশ্রাম নিতে পারতেন।
অফিস শেষে মোহাদি বিকেলে সে কিছু সময় বই পড়ত বাকি সময় বাগানে হাঁটাহাঁটি করতো। অন্য কারও সাথে তেমন মিশতো না সে। একদিন সন্ধায় পুরাতন কর্মী জনাব আজিজ উল্লাহ মোহাদির রেস্ট হাউজে এসেছিলেন। আজিজ উল্লাহ সাহেব ঐ কোম্পানীর সহকারী হিসাবরক্ষক কাম স্টোরকিপার। তিনি কোম্পানীর আশপাশেই থাকেন। তিনি খুব চতুর প্রকৃতির লোক।
জনাব আজিজ উল্লাহ মোহাদির কাছে অনেক কথা বলেছিলেন। তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্র কোন কিছুই বাদ রাখেন নি। তিনি বলেছিলেন,
যুবক বয়সে আমি রসোগোল্লা খাওয়ার প্রতিযোগিতায় যেতাম। একবার সে প্রতিযোগিতায় আড়াই সের (কেজি) রসোগোল্লা খেয়ে জিতেছিলাম। আমি একা খাই নি। আমার এক যমজভাই আছে। দেখতে ঠিক আমার মত। আমি অর্ধেক মিস্টি খেয়ে টয়লেটে যাবার কথা বলে আমার জামা বদল করে আমার ভাইকে পাঠিয়ে ছিলাম। তারপর সে এসে বাকি অর্ধেক মিষ্টি খায়। ফলে আমি যিতে যাই।
এরপর তিনি আর একটি খাওয়ার গল্প শুরু করতে যাচ্ছিলেন। সিটি ছিলো একটি আস্ত কাঁঠল খাওয়ার গল্প। মোহাদি তাকে থামিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণ পর আজিজ আবর বলা কথা শুরু করেন। তিনি বলেন,
শুনেন না আমরা যমজ হওয়ার কারণে আমার বিয়ের সময় কী হয়েছিল? … …. ….
এত কথা বলা মোহাদির পছন্দ হয় নি। ফলে সে তেমন মনোযোগ দিয়ে শুনে নি। যেহেতু আজিজ সাহেবের কথাগুলি অতিরঞ্জিত ছিল, তাই মোহাদি তার কথা কিছুটা অবহেলা করেছিল।এটা তার স্বভাবজাত ব্যাপার। আজিজ উল্লাহ সাহেব খুশি হতে পারেন নি। তিনি কিছুটা বেজার হয়ে চলে গিয়েছিলেন। তিনি কী উদ্দেশ্যে এসেছিলেন তা পরিষ্কার নয়। মনে হয় কোন ব্যাপারে ফায়দা করতে এসেছিলেন।
আজিজ সাহেবের বলা বিষয় নিয়ে মোহাদির বিন্দু মাত্র টেনশন ছিল না। উনি কী মনে করলেন তা নিয়েও কোন ভাবনা ছিল না। অন্য কেউ হলে হয়ত আজিজ সাহেবের কথায় গলে যেতেন বা স্রোতে গা ভাসাতেন। কিন্তু মোহাদি স্রোতে গা ভাসানো মানুষ নয়। তার নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি খুব মজবুত ছিল । আর দশজন সাধারণ মানুষ থেকে মোহাদি খানিকটা আলাদা। এধরনের লোকদের চলার পথে বাধা আসবেই। এটাই তো স্বাভাবিক।
এর কয়েকদিন আগে আজিজ উল্লাহ সাহেব মোহাদিকে অতিরিক্ত খরচ দেখানো ভাউচারে সই করতে অনুরোধ করেছিলেন। মোহাদি তা যথার্থ কারণ দেখিয়ে আসল খরচের ভাউচার তৈরি করতে বলেছিল। সত্য কথা বলতে মোহাদির কোন ভয় বা দ্বিধা ছিল না। মোহাদির কোন অনিয়ম পছন্দ না। কোন অনিয়ম দেখলে সে শক্ত নৈতিক চরিত্রের বহিপ্রকাশ ঘটায়। মোহাদির এ শিক্ষা খুব ভালো ছিল। ঐদিন আজিজ উল্লাহ সাহেব কোন বাধা দেন নি কিন্তু খুশিও হননি।
পরদিন অফিসে এসে জনাব আজিজ উল্লাহ অন্য কর্মীদের কাছে মোহাদির ব্যাপারে বিভিন্ন কথা ছড়াতে লাগলেন। যেমন নতুন অফিসার খুব অহংকারী, অন্যদের সম্মান করে না, ভাব দেখায় —– ইত্যাদি ইত্যাদি। কয়েক দিনের মধ্যে এসব কথা মোহাদির কানেও গেল। তার মন খারাপ হলো। আজিজ উল্লাহ সাহেবের প্রতি তার বিশ্বাসযোগ্যতা কমে গেল। দিন দিন দুজনের দূরত্ব বাড়তে লাগলো। আস্তে আস্তে সম্পর্ক খারাপের দিকে গেল। কারণ ছাড়াই মোহাদির কাজে পরোক্ষভাবে বাধা আসতে থাকলো।
মোহাদির কাজের জন্য ছোট আকারের খরচগুলি আজিজ সাহেব দিতেন। তিনি কারণ ছাড়া দিতে দেরি করতেন। দলের মধ্যে ভাঙ্গন ধরলো। অনেক কর্মী ভুল বুঝলো। কর্মীরা বিভিন্ন পক্ষ অবলম্বন করলো। কিছু লোক মোহাদির পক্ষে গেল, কিছু লোক আজিজ সাহবের পক্ষে গেল আর অল্প সংখক মানুষ নিরপেক্ষ থাকলো। তবে আজিজ সাহেবের দলেই বেশি লোক অবস্থান করলো। ফলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কোম্পানীর কার্যক্ষমতা কমে গেল।
কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার বিষয়টি জানলেন। তিনি গভীরে না গিয়ে আরও উষ্কে দিলেন। পরিস্থিতি আরও অবনতি হল। কোম্পানীর পরিচালক ও এমডি সাহেব বিষয়টি জানলেন। এমডি সাহেব বিষয়টি নিয়ে মিটিং করলেন । মিটিং এ সিদ্ধান্ত আসলো। জেনারেল ম্যানেজার তদন্ত করে বিষয়টি মিটিয়ে দিতে আদেশ আসলো।
পরদিন মোহাদির ডাক পড়লো জেনারেল ম্যানেজারের অফিসে। তিনি অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশের চাকরি শেষ করে প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি শুরু করেছেন। তিনি কোম্পানীর নিয়মকানুন তেমন জানেন না। বরং তিনি ভয় দেখিয়ে কাজ করানোর চেষ্টা করেন। মোহাদি তার কাছে অতটা স্বাচ্ছন্দবোধ করছিল না। মোহাদিকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, আজিজের সাথে আপনার কী হয়েছিল? মোহাদি খুঁজে পাচ্ছিল না সে কি বলবে।
মোহাদি কী আজিজ উল্লাহ সাহেবের আসল ঘটনা বলে দিবে? সে আসল বিষয় এড়িয়ে চললো। সে মনে করেছিল জিএম সাহেব কে আসল বিষয় বললে হিতে বিপরীত হতে পারে। সে শুধু বার বার বললো আমি তো কিছু করিনি। জেনারেল ম্যানেজার মোহাদিকে খুব বকাঝকা করছিলেন।
মোহাদির মন খুব খারাপ হলো। মন খারাপ করে রেস্ট হাউজে ফিরলো। বার বার ভাবল তার ভুলটা কোথায়? ঐদিন সে আর অফিস করলো না। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলো। প্রথমে ভাবলো সে চাকরিটা ছেড়ে দিবে। আবার ভাবলো চাকরি ছেড়ে দেওয়া তো সমাধান না । অন্য জায়গায় গেলেও, একই সমস্যা হতে পারে। আবার চাকরি কেন ছাড়বে? সে তো কোন দোষ করেনি।
অনেক ভেবে মোহাদি স্থির করলো অত সহজে সে হার মানবেন না। যেহেতু অফিসের ব্যাপার, মোহাদি বিষয়টি কোন বন্ধু বা পরিবারের কারও সাথে শেয়ার করেনি। অফিসের বিষয় অফিসিয়্যালি সমাধান করা উচিত বলে মোহাদি মনে করেছিল। আবার সে ভেবেছিল, ৩ মাসের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দেওয়াও নেতিবাচক বিষয়।
অনেক ভেবে রাতে খাওয়ার পর মোহাদি তার মেন্টরকে মোবাইলে কল করেছিল। যা ঘটেছিল তা বিস্তারিতভাবে জানিয়েছিল। মোহাদির মেন্টর খুব প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি। মোহাদি বিপদে পড়লে তাঁর কাছে ছুটে যায়। তিনি মোহাদিকে তৎক্ষণাৎ কিছু না বলে সময় নিয়েছিলেন। কয়েক দিনের মধ্যে তার অফিসে দেখা করতে বলেছিলেন।
মেন্টরের কাছে থেকে পরামর্শ পেয়ে মোহাদি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেল। সে মনে করল অন্যকে পরিবর্তন করা খুব কষ্টকর বা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কিন্তু নিজেকে পরিবর্তন করা অনেক সহজ। গত কয়েক সপ্তাহে অফিসে যে এত কিছু ঘটেছে তা সে সম্পূর্ণ ভুলে গেল। সবার আগে অফিসে উপস্থিত হত। সবাইকে আগে আন্তরিকভাবে সালাম দিত। আজিজ উল্লাহ সাহেবের প্রতি তার কোন ক্ষোভ বা রাগ ছিল না। তার সাথে এমন ব্যবহার করল মনে হয় কিছুই হয়নি।
মোহাদির এমন উষ্ণ ব্যবহারকেও অনেকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। কোন কোন সমালোচকদের বিভিন্ন কথা ছড়াতে শোনা যায়। যেমন একজন মোহাদিকে দেখে আজিজ উল্লাহ সাহেবের সামনে বলেছিল, “জিএম স্যারের ঝাড়িতে সোজা হয়ে গেছে। আমাদের সঙ্গে পারা অত সহজ নয়। আমার এ জীবনে কত বাঘ আর মহিষ কে এক ঘাটে জল খাওলাম।” আরও কত কী!
মোহাদি কোন সমালোচনায় কান দিলো না। উল্টো সবার সাথে ভালো ব্যবহার করল। সে মানসিকভাবে খুব শক্ত অবস্থানে থাকলো। সে তার মেন্টরের কাছে খুব ভালোভাবে স্ট্রেস ম্যানেজ করার সব কৌশল শিখে নিয়েছে। সে এখন জানে কীভাবে ক্রিটিক্যাল অবস্থা ম্যানেজ করতে হয়। সে বিভিন্নভাবে সব সহকর্মীদের সহযোগিতা করতে লাগলো। ভুলেও সে কোন সহকর্মীর সমালোচনা করে নি। সে জানতো সমালোচনা খুব খারাপ জিনিস। এটা অনেকটা মৌচাকে ঢিল মারার মত।
মোহাদির অধীনস্থরা কোন ভুল করলে খুব ভদ্রভাবে ভুল ধরিয়ে দিত। কেউ বিপদে পড়লে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতো। এর মধ্যে আজিজ উল্লাহ সাহেবের এক নিকট আত্মীয়ের এক ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে মোহাদি সাহায্য করেছে। সে ছেলেটির বাবা খুব দরিদ্র ছিল। ছেলেটির কোন ভালো গাইডলাইন ছিলো না। মোহাদির বুদ্ধি-মরামর্শে তার পছন্দ মত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুয়োগ পেয়েছে। একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সাহয্যেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সে মোহাদির খুব ভক্ত হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে আজিজ উল্লাহ সাহেব বিষয়টি জানতে পারলেন। ফলে তিনি মোহাদির উপর কিছুটা খুশি হলেন। মোহাদির উপর তার ক্ষোভ কমে গেল।
মোহাদির আন্তরিক ব্যবহারে আজিজ সাহেব আগের অবস্থান থেকে নিজেকে পরিবর্তন করলেন। শেষ পর্যন্ত মোহাদিকে পছন্দ করা শুরু করলেন। অন্যান্ন কর্মীদের মধ্যেও ভালো সম্পর্ক তৈরি হতে লাগলো। ফলে সবার মধ্যে সহযোগিতা বাড়তে লাগলো। ক্রমান্বয়ে মোহাদির দল আরও মজবুত হলো। সকলের সহযোগিতায় কোম্পানীর কার্যক্ষমতা বেড়ে গেল। কোম্পানীর উর্ধতন কর্মকর্তারা খুব খুশি হলেন। সকলের কাছে মোহাদি বেশ প্রশংসিত হলো।
পরবর্তী অধ্যায়: যে দায়িত্বশীল সে সহজে সমস্যা সমাধান করতে পারে।