মোহাদি ভাবতো গ্রামের মানুষের অনেক সমস্যা আছে। এসব সমস্যা গুলি সমাধান করতে পারলে গ্রামের মানুষের উপকার করার পাশা-পাশি গ্রামের উন্নয়ন করা যাবে। এজন্য সে মাঝে মাঝে গ্রামে যেত। যদিও সে অনেক ব্যস্ত তার পরও সে গ্রামের সমস্যা সমাধানে চিন্তা করতো। অনেক জ্ঞানী লোকের সাথে এসব নিয়ে কথা বলতো। গ্রাম উন্নয়ন বিষয়ে অনেক প্রবন্ধ ও বই পড়তো।
নিজের গ্রাম মোহাদির কাছে খুব প্রিয়। এর প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব সুন্দর। গ্রামের মধ্যে দিয়ে নদী বয়ে গেছে। শহর থেকে রাস্তায় নদীর পাড় ঘেঁসে বয়ে চলে গেছে। বড় বড় তিনটি ফসলের মাঠ তিনদিকে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, খেলার মাঠ, বাজার, ঈদগাহ্ সবই রয়েছে মোহাদিদের গ্রামে। সব মিলে একটি আদর্শ গ্রাম। এখানেই মোহাদি তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান করতে চায়। সে চায় তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রামের কিছু সমস্যা সমাধান করতে পারবে।
প্রাকৃতিক অবস্হান ও সৌন্দর্যের দিক থেকে মোহাদিদের গ্রাম সুন্দর হলেও সেখানে অনেক ধরনের সমস্যা রয়েছে। প্রধান সমস্যা গুলির মধ্যে কুসংস্কার, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভাজন, প্রকৃত শিক্ষার অভাব, বেকারত্ব, সুদের ব্যবসা, বাল্য বিবাহ, দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য। গ্রামে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও মানুষ প্রকৃত শিক্ষাকে বাদ দিয়ে কীভাবে সংক্ষিপ্তভাবে টাকা উপার্জন করা যায় তার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। অনেক স্কুল পড়ুয়া ছেলেরা স্কুল ছেড়ে কোনো দক্ষতা অর্জন না করে বিদেশ গিয়ে টাকা উপার্জনকে প্রধান মনে করছে। মানুষের কাছে শিক্ষার প্রকৃত মূল্য নেই বললেই চলে। তার উপর গ্রাম্য-রাজনীতি গ্রামের পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে দিচ্ছে।
মোহাদি তার প্রতিষ্ঠানের জন্য জায়গা ঠিক করলো। জায়গাটি তার নিজের টাকা দিয়ে কেনা। প্রথমে সে একজন কেয়ারটেকার নিয়োগ দিলো । এ কাজে তাকে সাহায্য করলেন তার দুলাভাই জব্বারুল ইসলাম ও বড় ভাই মোজাক্কের। প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করে মোহাদি শহরে ফিরে এলো। কিন্তু তার গ্রাম উন্নয়নের কাজে প্রথম বাধা আসলো আনিতার কাছ থেকে। আনিতা আগে থেকে মোহাদির গ্রামে প্রতিষ্ঠান তৈরির কথা জানতো। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও বাধা দেয় নি। এবার যখন কাজ শুরু হয়েছে তখন সরাসরি বাধা দিলো। এটা নিয়ে দুইজনের মধ্যে অনেক কথা কাটা-কাটি হলো। কয়েক দিন আনিতা মোহাদির সাথে কথা বললো না।
আনিতা কে বিভিন্নভাবে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করলো। কয়েক সেট পোশাক কিনে দিলো, কিছু অলঙ্কার কিনে দিলো এবং ভালো একটি রেস্তোরাঁতে খাওয়ালো। তাতেও কোনো লাভ হলো না। কারণ ছাড়াই আনিতা রাগা-রাগি করতো। সামান্য ভুল পেলেই বাচ্চার গায়ে হাত তুলতো। রান্না ঠিক মতো করতো না। বেশির ভাগ সময় মোহাদি বাহিরে খেতো। সব মিলে একটি অশান্তির পরিবেশ তৈরি হলো। মোহাদি মহা ঝামেলায় পড়লো। এক দিকে কাজের চাপ, অন্য দিকে সংসারে অশান্তি।
আনিতার সাথে ঝামেলা মেটাবার জন্য মোহাদি সুনিতার সহযোগিতা নিতে চাইলো। অফিস শেষে তারা একটি কফি হাউজে দেখা করলো। সুনিতা বিষয়টি আগে থেকে জানতো। বড় বোনের কাছে থেকে আগেই শুনেছিলো। সে বোনের কথা বিশ্বাস করে মোহাদির বিপক্ষে গেলো। মোহাদি খুব হতাশ না হয়ে তার শ্বশুড় কে ফোন করলো। তিনিও মেয়ের পক্ষ নিলেন। আনিতাদের পরিবারে মোহাদি একজন দোষী জামাই। তাদের কাছে মোহাদির দোষ হচ্ছে সে সংসারে বউ-বাচ্চার প্রতি মনোযোগ নেই। নিজের সংসারে কম টাকা খরচ করে অথচ নিজের গ্রামে কাড়ি-কাড়ি টাকা খরচ করছে।
আস্তে আস্তে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে লাগলো। মোহাদি নতুন নতুন কৌশল বের করে পরীক্ষা করতে লাগলো। এ কাজে অনেক পরীক্ষায় ফেল করে সে মায়ের কাছে শেয়ার করলো। যেহেতু পারিবারিক বিষয় তাই সে পরিবারের মধেই রাখতে চাইলো। বাহিরে কারও সাথে শেয়ার করলো না। বেশ কয়েক ঘন্টা সময় নিয়ে ইবাদুননেসা ভাবলেন। শেষে ছেলেকে উপদেশ দিলেন যে তার পরিমাণ অর্থ গ্রাম উন্নয়নে খরচ হবে তার সমান পরিমাণ সম্পদ আনিতাকে দিতে। মোহাদি প্রথমে না মানলেও মায়ের আদেশ আর সংসারের সুখের জন্য মেনে নিলো। শহরের ফ্ল্যাটটি আনিতার নামে রেজিস্ট্রি করে দিলো। আনিতা ফ্ল্যাটটি নিজের নামে পেয়ে কিছুটা শান্ত হলো। আস্তে আস্তে মোহাদির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলো।
মোহাদির গ্রামের প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো সম্পূর্ণ প্রস্তুতি হয়েছে। এটাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করলো। এর এক পাশে একটি মাঝারি আকারের পাঠাগার তৈরি করলো। গ্রামে যেসব শিক্ষিত ও অর্ধ-শিক্ষিত লোক আছেন, তারা অবসর সময়ে এখানে এসে বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। এখানে পড়ার পরিবেশ খুব সুন্দর। পরিচ্ছন্ন জায়গা। কোনো কোলাহল নেই। যথেষ্ট আলো রয়েছে। বড় বড় কাঠের আলমারিতে বই গুলি সাজানো রয়েছে। এখানে অনেক ধর্মীয় ও জীবনী গ্রন্থ রয়েছে। যারা বই পড়েন তাদের কোনো ফি দিতে হয় না। শুধু তাদের নাম রেকোর্ড বইয়ে লিখে সাইন করতে হয়।
পাঠাগারে ইন্টারনেট সংযোগসহ দুইটি কম্পিউটার রয়েছে। এখানে সারা দুনিয়ার তথ্য পাওয়া যায়। গ্রামের অনেকেই এগুলোর ব্যবহার শিখে নিয়েছে। এখানে সব সময় বিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে। এজন্য পল্লীবিদ্যুতের পাশা-পাশি সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পাঠাগারের পাশে একটি বড় কক্ষ রয়েছে। কক্ষটি সব ধরনের আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। এখানে কমপক্ষে ৫০ জন মানুষ এক সাথে বসতে পারে। এটা সব ধরনের প্রশিক্ষণ ও মিটিং এর জন্য তৈরি করা। এছাড়া বয়স্ক ও ধর্মীয় শিক্ষা এখানে চালু রয়েছে। এর জন্য কোনো স্থায়ী শিক্ষক বা প্রশিক্ষক নেই। গ্রামের শিক্ষিত লোকেরা স্বেচ্ছায় এ কাজ করে থাকেন। বিভিন্ন ফসলের মৌসুমে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এর জন্য কৃষি অফিসারদের ডেকে আনা হয়। পশু-পাখি পালন ও রোগ দমন বিষয়ে গ্রামের মানুষদের সচেতন করার জন্য উপজেলা থেকে পশু চিকিৎসকদের আমন্ত্রণ করা হয়। এসবই আয়োজন করে প্রতিষ্ঠানের কেয়ারটোর শাহআলম মিয়া। মোহাদি মাঝে মাঝে শহর থেকে ভালো প্রশিক্ষক পাঠাতো। তারা শিক্ষিত ও বেকার লোকদের কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। বিভিন্ন ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি এ প্রশিক্ষণে শেখানো হয়। শ্রমিক ভিসায় যারা বিদেশে যেতে চায়, তাদের কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের সম্মুখভাগে একটি বাগান রয়েছে। তার পাশে রয়েছে একটি নার্সারি। এখানে উন্নত বীজ থেকে সব ধরনের চারাগাছ উৎপাদন করা হয়। একজন নার্সারি বিশেষজ্ঞ কে মোহাদি নিয়োগ দিয়েছে। তিনি সপ্তাহে একদিন এসে কাজ তদারক করে পরামর্শ দিয়ে যান। ভিন্ন গ্রাম থেকে অনেকে আসে এখান থেকে নতুন নতুন গাছের চারা কিনতে।
মোহাদির প্রতিষ্ঠানের চতুর্থ ভাগ হচ্ছে বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি। এগুলো খুব কম টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়। ফলে গ্রামের কৃষকগণ খুব উপকৃত হতো।
গ্রামের প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে যে খরচ হয়েছে মোহাদি নিজে তা অর্থায়ন করছে। এখন নতুন করে কোনো খরচ হয় না। কর্মচারীর বেতন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ আসে যন্ত্রপাতির ভাড়া আর চারা বিক্রি করে। তৃতীয় আয়ের উৎস হলো বিদ্যুৎ বিক্রি করে। মোহাদি তার প্রতিষ্ঠানে পল্লীবিদ্যুৎ ও সৌরবিদ্যুৎ কাজে লাগিয়ে নেটমিটারিং সিসটেম তৈরি করছিল। এর জন্য কোনো রক্ষণাবেক্ষণ খরচ নেই। কোনো খরচ ছাড়াই প্রতি মাসে বাড়তি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডে বিক্রি করে কিছু টাকা উপার্জন হয়। চতুর্থ আয়ের উৎস হলো অফিস ভাড়া দিয়ে। প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় তলা একটি এনজিও ভাড়া নিয়েছে। মোটামুটি ভালো পরিমাণ ভাড়া আসে। পঞ্চম আয়ের উৎস হলো প্রতিষ্ঠানের ছাদে মোবাইল কোম্পানীর টাওয়ার ভাড়া দিয়ে। আয়ের ষষ্ঠ উৎস হলো জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয় করে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রামের কিছু জিনিস শহরে যায় আর শহরের কিছু জিনিস গ্রামে আসে। ফলে গ্রামের মানুষ তার প্রয়োজনীয় জিনিস পায় আর তাদের উৎপাদিত পণ্য ভালো দামে বিক্রি করতে পারে। এ কাজের দায়িত্বে ছিল মোহাদির ছোট ভাই মোসাব্বের। ঠিক মতো জিনিসপত্র আনা-নেওয়া করার জন্য প্রাইভেট কুরিয়ার কোম্পানীর সাথে চুক্তি করা হয়েছে। মোহাদি প্রতি সপ্তাহে এসব কাজের তদারক করতো।
কয়েক বছরের মধ্যে গ্রামে মোহাদির প্রতিষ্ঠানের প্রভাব পড়তে লাগলো। কৃষকদের বেশি ফসল ফলতে লাগলো। অনেকের স্বচ্ছলতা ফিরে এলো। গ্রামে বেকারত্ব কমে গেল। অনেক মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়ে গেল। অনেক মানুষ সুদের ব্যবসা থেকে সরে আসলো। অনেকে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যে বুঝতে সক্ষম হলো। কুসংস্কার অনেকাংশে কমে গেলো। গ্রামের লোকদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হলো। বাল্য বিবাহ কমে গেল। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ একে অপরকে বিভিন্ন কাজে সহায়তার করতে লাগলো। গ্রাম ও শহরের মধ্যে তথ্য প্রবাহ অবাধে চলতে লাগলো। আস্তে আস্তে গ্রাম উন্নতির দিকে যেতে লাগলো। এসব সংবাদ আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। চারদিকে মোহাদির সুনাম ছড়িয়ে পড়লো।
পরের অধ্যায়: মোহাদির প্রতিষ্ঠানের বড় বিপদ কেটে গেল