মিতব্যয়ী মোহাদি উন্নতির দিকে
মোহাদির বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে। সেজন্য সে অফিস থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছে। তার মা ইবাদুননেসা ঘর বাড়ি পরিষ্কার করছেন। তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তাঁর মন খারাপ হচ্ছে বেশি তাঁর মেজো ছেলে, মোজাক্কের জন্য। তাকে বাদ রেখে সেজো ছেলে মোহাদির বিয়ে দিচ্ছেন। আবার হাতে টাকা-পয়সা না থাকায় পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের দাওয়াত দিতে পারছেন না। শুধুমাত্র দাওয়াত করেছেন নিজের ভাইবোন আর ছেলেমেয়েদের।
দাওয়াত পেয়ে তার দুলাভাই জব্বারুল ইসলাম তিন দিন ধরে অবস্থান করছেন। তিনি মহা আনন্দে আছেন। তিনি মোহাদিদের অভাবের সংসারে বসে খাচ্ছেন আর গ্রামের বাজারের চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন। তিনি কোন দায়িত্ব না নিয়ে বিভিন্ন ভুল ধরায় ওস্তাদ। এছাড়া তার আবদারের শেষ নেই। তার নতুন জামা, প্যান্ট আর জুতার জন্য শ্বশুর বাড়ির লোকদের চাপ সৃষ্টি করছেন।
মেন্টরের উপদেশ মতো মোহাদি খুব সংক্ষেপে বিয়েটা সারতে চায়। এজন্য বাড়িতে কোন আয়োজন নেই। বিয়ের জন্য সামান্য কিছু কেনা-কাটা করেছে। এর মধ্যে তার নিজের জন্য একটি পাজামা-পাঞ্জাবি ও জুতা কিনেছে। আর বউয়ের জন্য একটি ট্রলি ব্যাগ, দুটি শাড়ি, কিছু কসমেটিক্স ও আনুসঙ্গিক কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনেছে।
বিয়ের দিনে মোহাদি বর সেজে অল্প কয়েকজন বরযাত্রী আনিতাদের বাড়িতে উপস্থিত হল। তাদের বাহন ছিল দুটি ভ্যান গাড়ি। একই দিনে আনিতার ছোট বোন সুনিতারও বিয়ে। সুনিতার বিয়ে হচ্ছে এক সরকারি কর্ম-কর্তার সাথে। তাদের বিশাল আয়োজন। প্রায় পাঁচশ লোক এসেছে বরযাত্রী হিসেবে। সঙ্গে এসেছে সুসজ্জিত ব্যান্ডপার্টি। আর তাদের বাহন হচ্ছে দশটি বাস ও দশটি ব্যক্তিগত গাড়ির বহর।
যথারীতি বিয়ে শেষ হল। পরদিন মোহাদিদের বাড়িতে কোন আয়োজন নেই। অন্য দিকে সুনিতার বাড়িতে বিশাল বউভাতের আয়োজন করা হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীর বিয়ে বলে কথা। প্রায় দুই হাজার মানুষকে দাওয়াত করা হয়েছে। শ্বশুর বাড়ির গ্রামশুদ্ধ দাওয়াত করা হয়েছে। আনিতাদের গ্রামের বিধবা মহিলা বানেছার মাও বাদ পড়েনি। তিনদিন পর সুনিতার ও তার বর ১৫ দিনের জন্য মালদ্বীপে হানিমুনে গেল।
মোহাদির ছুটি শেষ। শেষ দিনে বউকে নিয়ে তার এক কামরার বাসায় হাজির হলো। বাসায় অনেক কিছুই কিনতে হবে। তারপরও জোড়াতালি দিয়ে তারা সংসার শুরু করলো। তারপরও আনিতা খুব খুশি। পরদিন মোহাদি অফিসে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিল। আনিতা তার দুপুরের খাবার সঙ্গে দিলো।
মোহাদি ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছালো। তার সহকর্মীরা তাকে অভিনন্দন জানালো। কেউ কেউ খাওয়ানোর আবদার করলো। সে কথা দিল সামনের মাসে সব সহকর্মীদের দাওয়াত দিবে। এটি নিয়ে বাসায় গিয়ে আনিতার সাথে আলোচনা করলো। মুশকিল হল তাদের বাসা অনেক ছোট। আট-দশ জন মানুষ এখানে বসে খাওয়ার যথেষ্ট জায়গা নেই। কোনো রেস্তোরাঁতে যে খাওয়াবে তারও উপায় নেই। কারণ হাতে যথেষ্ট টাকা নেই। শেষে তারা সিদ্ধান্ত নিল আনিতা একদিন রান্না করে পিয়নের মাধমে অফিসে পৌঁছে দেবে।
টাকা-পয়সার টান থাকলেও মোহাদি ও আনিতা খুব সুখেই আছে। বিয়ের আগে মোহাদি বই পড়ে অবসর সময় কাটাতো আর বিয়ের পর আনিতার সাথে বিভিন্ন নিয়ে কথা বলে সময় কাটায়। আনিতা সারা দিন সংসারের কাজের পাশা-পাশি কখনও টিভি দেখে, কখনও বা মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে। সে প্রায় প্রতিদিনই শ্বাশুড়ির খবর নেয়। আর বিকেল হলেই মোহাদির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে। এভাবে তাদের সংসার জীবন কাটতে লাগলো।
মোহাদির অফিসে দায়িত্ব বেড়েছে। এজন্য মাঝে মাঝেই বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এ ব্যাপারে সে আনিতাকে আগেই জানায়। আনিতাও কিছু মনে করে না।
একদিন মোহাদি বাসায় ফিরে দেখে আনিতা দরজা খুলতে একটু দেরি করলো। অন্য দিন কখনও তা হয় না। আনিতার মন খারাপ। মোহাদি ভয় পেয়ে গেল। সারাদিন একা একা থাকে, কোন দূর্ঘটনা ঘটেনি তো? মোহাদি বুঝার চেষ্টা করলো। কিছুই বুঝতে পারলো না। রাতে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো। আনিতা কিছুই বললো না। মোহাদির আরও ভয় বেড়ে গেল। ভাবলো আস্তে আস্তে হয়ত ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু রাতেও আনিতা মোহাদির সাথে তেমন কথা বললো না। সকালে তাকে আবার অনুরোধ করলো, “কাল থেকে তুমি চুপচাপ কেন? কী হয়েছে তোমার? আমি কী কোনো কষ্ট দিয়েছি?” শেষে আনিতা মুখ খুললো। বললো সুনিতা ফোন করেছিল। ও গতকাল মালদ্বীপ থেকে হানিমুন সেরে দেশে এসেছে। তার বর তাকে অনেক ড্রেস, গয়না, কসমেটিক্স ও আইফোন কিনে দিয়েছে।
মোহাদি আনিতার মন খারাপের কারণ বুঝলো। আনিতার মন ভালো করার জন্য বিভিন্ন গল্প করার চেষ্টা করলো। পরদিন আনিতাকে একটি রেস্তোরাঁতে খাওয়াতে নিয়ে গেল। তার সামর্থের মধ্যে আনিতার জন্য কিছু কেনা-কাটা করলো। বেচারী আনিতার তেমন ভালো পোশাক নেই। যেগুলি আছে, সব বিয়ের আগের । আর গয়না বলতে আছে শ্বাশুড়ির দেওয়া এক জোড়া বালা আর একটি বড় নেকলেস।
আনিতা অনেক আবেগিক হলেও অল্পতে খুশি। আস্তে আস্তে মোহাদির সাথে আবার সম্পর্ক ভালো হল। এভাবে কেটে গেল প্রায় ছয় মাস। এর মধ্যে মোহাদি চাকরি পরিবর্তন করেছে। নতুন চাকরিতে মোহাদির বেতন আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। বাসাও বদল করে দুই কামরার বাসায় উঠেছে। প্রয়োজনীয় সব খরচ মিটিয়ে ভবিষ্যতের জ্ন্য তারা স্থায়ী আমানত হিসেবে কিছু টাকা জমানো শুরু করেছে। কিন্তু তারা কোনো অপব্যয় বা অপচয় করতো না। তাদের অতিরিক্ত খরচ বলতে শেখার কাজে তারা কার্পণ্য করতো না। তারা দুজনেই মাঝে মধ্যে বাক্তিগত ও পেশাগত উন্নতির জ্ন্য বিভিন্ন হলিডেই কোর্স করতো। মোহাদি এটাকে বিনিয়োগ হিসেবে মনে করতো। এভাবে ধীরে ধীরে আনিতার সংসারে উন্নতি হতে লাগলো।
অন্য দিকে সুনিতা খুব বিলাসিতা ও অপচয়ের মধ্যে জীবন যাপন করতো। তার ঘুষখোর স্বামী মাঝে মধ্যে পার্টি করে মদ পান করে বাসায় ফিরতো। তারা প্রায় প্রতিদিন ঝগড়া করে ঘুমাতে যেত। সুনিতার স্বামীর টাকার অভাব নেই। তার রয়েছে কয়েকটি আ্যপার্টমেন্ট, অসংখ্য প্লট, কয়েকটি দামি গাড়ি ও অনেক ব্যাংক ব্যালেন্স। তিনি বছরে কয়েকবার বিদেশ ভ্রমণ করেন। বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত ক্লাবের সদস্য। অথচ তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিজীবী।
আনিতার সাথে সুনিতার অত বেশি যোগাযোগ ছিল না। সুনিতার জাঁকজমকপূ্র্ণ জীবনযাপনের মধ্যে গিয়ে বোনকে সপ্তাহে একদিনও ফোন করে না। এক রাতে আনিতা শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল তখন সুনিতার ফোন এল। ফোন পেয়ে খুব খুশি হয়ে গেল। খুব দ্রুত ফোনটি ধরেই আনিতা বললো, “এত দিন পর বোনের কথা মনে পড়লো?” অপর প্রান্ত থেকে আনিতা কান্নার শব্দ শুনতে পেল। কাঁদতে কাঁদতে সুনিতা বলল, “আপু, সর্বনাশ হয়ে গেছে।” সুনিতা আরও বললো, “বাসায় পুলিশ এসে ওকে ধরে নিয়ে গেছে। আমি এখন কী করবো?”
সুনিতার স্বামীর অন্যায় করা টাকা উপার্জনের কথা প্রকাশ হয়ে গেছে। অন্যায় কখনও চাপিয়ে রাখা যায় না। সে অন্যায়ভাবে অনেক টাকার মালিক হয়েছিল। সে টাকার মোহে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে কোন নিয়ম ও আইনের তোয়াক্কা না করে দুই হাতে ঘুষ খেতো আর অপচয় করতো। এত সব অন্যায় কাজের জন্য তার নামে মামলা হয়েছে। তাই পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে। সরকারি টাকা নয়ছয় করার জন্য তার নামে অনেকগুলি মামলা হয়েছে।
মোহাদি ও আনিতা খবর পেয়ে সুনিতার বাসায় গেল। তারা সাধ্যমত চেষ্টা করলো বিপদের দিনে সুনিতার পাশে থাকতে। মোহাদি ভালো উকিল ধরলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। পরিস্থিতি অনেক জটিল হওয়ায় সুনিতার স্বামীর কোন জামিন করতে পারলো না। পরবর্তীতে বিচারে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় সব মামলা ১২ বছরের জেল হলো এবং তার সব অবৈধ সম্পদ আদালত বাজেয়াপ্ত করলো এবং সরকারের কোষাগারে চলে গেলো।
সুনিতার ভাগ্য ভালো তার স্বামী তার নামে কোনো সম্পদ করে নি। ফলে সে মামলা থেকে বেঁচে যায়। মোহাদি তাকে তাদের বাসায় নিয়ে এলো। কিছুদিন পর দক্ষতা উন্নয়নের উপর তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলো। সুনিতা ভালো ছাত্রী ছিল। তাই সহজে আয়ত্ব করে ফেললো। এরপর সুনিতা একটি চাকরি শুরু করলো। আর স্বামীর জন্য দিন গুণতে থাকলো।
পরবর্তী অধ্যায়: মোহাদির আলাদা একটি স্বপ্ন আছে