আমার কর্ম জীবনের প্রায় দেড় দশক পার হতে চললো। এ সময়ে এসে উপলব্ধি করছি যে মানুষের জীবনে ভালোভাবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে তার নিজের ইচ্ছা ও সামর্থ্য আগে জানতে হবে। মন থেকে মানুষ যে কাজ পছন্দ করে, সে কাজে সে সহজে ভালো করতে পারে। এ কাজের জন্য তাকে কোনো বল প্রয়োগ করতে হয় না। নিজের ইচ্ছায় সব সময় কাজ করতে পারে। কোনো রকম বিরক্তি থাকে না। কিন্তু কোন কাজ আপনার ভালো লাগবে তা খোঁজে বের করা খুব সহজ না। এখন এ কাজ ভালো তো কাল আর একটি ভালো লাগে। অনেকের আবার মানুষের দেখাদেখি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজ শুরু করে। নিজেকে ভালোভাবে না জেনে ভাবে – মানুষ কী বলবে । বিসিএস ক্যাডার হতে পারলে মানুষ বেশি ভালো বলবে। আবার অনেকে ভাবে, অনেক টাকা উপার্জন করতে পারলে বা অনেক ক্ষমতাশীল হতে পারলে মানুষের কাছে সুনাম অর্জন করা যাবে।
নাটার (একটি কাল্পনিক নাম) কথা ধরা যাক। সে স্কুলে পড়াকালে ভেবেছিল ভালো খেলোয়াড় হবে। কারণ এতে ভালো করতে পারলে সম্মান ও টাকা দুটোই আছে। এ জন্য কয়েক মাস ক্রিকেটের ব্যাট-বল নিয়ে খুব ব্যস্ততা দেখিয়ে ছিল। বছর যেতে না যেতেই তার খেলোয়াড় হওয়ার আগ্রহ শেষ। একবার চোট খেয়েই খেলা ছেড়ে দেয়। যদি তার সত্যকারেই খেলার প্রতি প্যাশন থাকতো তাহলে এবার কেন বার বার চোট পেলেও খেলা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতো না।
নাটা ভাবলো খেলা অনেক কষ্টের কাজ। এর চেয়ে চিত্রকর হওয়া সহজ। কারণ এতে চোট লাগার কোনো সম্ভাবনা নেই। সে জন্য সে ছবি আঁকার সব জিনিসপত্র কিনে ছবি আঁকা শুরু করলো। অঙ্কন শেখার কোর্সে ভর্তি হলো। খুব পরিশ্রম করতে লাগলো। অনেক ছবি অঙ্কন করলো। ছবিগুলি ভালোই ছিল। ছোটো-খাটো একটি প্রদর্শনীতে অংশ গ্রহণ করলো। খুব ভালো সাড়া পেলো না। কিছু লোক নাটার ছবিগুলোর জন্য সমালোচনা করলো। নাটার মন ভেঙ্গে গেল। তার চিত্রকর হওয়ার স্বপ্ন শেষ।
পাড়ার এক সিনিয়র ভাই ভালো সরকারি চাকরি (বিসিএস ক্যাডার) পেয়েছে। সব মানুষ তার খুব সুনাম করছে। দেখে নাটা তার ভক্ত হয়ে গেল। সে ভাবলো বিসিএস ক্যাডার হতে পারলে জীবন সাফল্যে ভরে উঠবে। এবার তার লক্ষ্য বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। শুরু করলো পড়াশোনা। এর মধ্যে সে বিশ্ববিদালয়ে পা দিয়েছে। তার বিভাগের রুটিন মাফিক পড়ার পাশা-পাশি বিসিএস এর পড়াশোনা শুরু করলো। বছর দুয়েক খুব সিরিয়াস ছিল। সে লক্ষ্য করলো সাধারণ জ্ঞান অনেক কঠিন। সে ঠিকমত মনে রাখতে পারে না। ফলে নাটা আবার আশাহত হলো। সে ভাবলো বিসিএস এর চেষ্টা করলে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া আর শেষ করা হবে না। তার পক্ষে দুটো একসাথে টানা সম্ভব ছিল না। তাই সে বিসিএস এর চেষ্টা ছেড়ে দিলো।
ভালো অভিনেতা হতে পারলে খুব সহজে সেলেব্রিটি হওয়া যাবে। তাই নাটা বিসিএস এর চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে অভিনয় শিখতে থাকলো। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে নাটক- ছিনেমা দেখা শুরু করলো। একটি থিয়েটারে নাম লেখালো। কিন্তু নিয়মিত প্রাকটিসের অভাবে সে অভিনয়ে ভালো করতে পারলো না। কয়েক মাস চেষ্টা করার পর সে অভিনয়ের আশা বাদ দিলো। এবার সে পায় মন দিলো।
অনেক কিছুর পর নাটা যথারীতি গ্রাজুয়েশন শেষ করলো। সে ভাবলো ব্যাংকের চাকরি তো ভালোই। ছিমছাম পরিবেশ, বেতনও সন্তোষজনক। ফলে সে ব্যাংকের চাকরির প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। প্রায় ছয় মাসের চেষ্টায় চাকরিটা সে পেয়ে গেল। কিছু মাস তার চাকরি ভালোই চললো। এরপর তার মধ্যে এক ধরনের ক্লান্তি কাজ করতে লাগলো। বাসায় এসে মন মরা হয়ে বসে থাকে। কাজে ভুল হতে লাগলো। ক্যাশের কাজ খুব ঝামেলার। এতে ঝুঁকিও ছিল। মনের উপর একটি চাপ তৈরি হলো। তার উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়লো। একটার পর একটা কারণ দেখানো চিঠি পেতে থাকলো। বছর ঘুরতে না ঘুরতে তার চাকরি চলে গেল। চাকরির ব্যাপারে নাটার খারাপ ধারণা তৈরি হলো। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল- সে আর চাকরি করবে না। পরিবারের লোকজন তাকে বিভিন্ন দোষ ধরতে লাগলো। তার বন্ধুদের মধ্যে আলোচনার বিষয় হয়ে গেলো। এমন কী, লুসি তার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিলো। কারণ নাটার চাকরি না থাকলে তাদের বিয়ে হবে না।
নাটা ভাবলো ব্যবসা শুরু করতে পারলে তাড়াতাড়ি ধনী হতে পারবে। নিজের জমানো সামান্য টাকা আর কিছু টাকা ধার করে অন্য বন্ধুর সাথে ছোট আকারের ব্যবসা শুরু করলো। ছয় মাস সাধ্যমত চেষ্টা করলো । কোনো লাভ তো হলো না, উল্টো পুঁজি হারিয়ে দিশাহারা। আসলে ব্যবসা করতে যে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও ধৈর্য্য লাগে, নাটার মধ্যে তার বিন্দুমাত্র ছিলো না। ফলে সে ঋণী হয়ে পড়লো। গ্রামের জমি বিক্রি করে ঋণী শোধ করে কোনো রকমে সে রক্ষা পেল।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে নাটা মোহাদিকে চিনতো। মোহাদি তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে গিয়েছিলো। সে মোহাদির সাথে দেখা করলো এবং তার বিপদের কথা শেয়ার করলো। বিস্তারিতভাবে শোনে মোহাদি তাকে সাহায্য করতে রাজি হলো। কয়েক দিনের চেষ্টায় নাটার প্যাশন খোঁজে বের করলো। মোহাদি লক্ষ্য করলো – নাটা খুব ভালোভাবে যে কোন ঘটনা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করতে পারে। এতে সে মোটেও বিচলিত হয় না, বরং তাকে আত্মবিশ্বাসী দেখায়। তার লেখার হাতও খুব ভালো। কোনো ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে সে মোটেও পক্ষপাত অবলম্বন করে না, বরং যথেষ্ট নিরপেক্ষতা বজায় রাখে । তারপর সে খুব সাহসী ব্যক্তি। সত্য ঘটনা উৎঘাটন করতে সে মরিয়া। বার বার ব্যর্থ হয়েও সে থেমে যায় না।
মোহাদি নাটাকে একটি তথ্য সংগ্রহ করে রিপোর্ট করার কাজ দিল। কাজটি যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ছিল। নাটা খুব ভালোভাবে কাজটি করলো। তার কোনো জড়তা, ক্লান্তি বা ভয় ছিলো না। এবং কয়েক দিনের কাজে কিছু টাকা আয় করতে পারলো।
নাটার কাজে খুশি হয়ে মোহাদি তাকে সাংবাদিকতার কাজে প্রশিক্ষণ নিতে উপদেশ দিলো। নাটাও তাই করলো। প্রশিক্ষণ চলাকালে সে সাংবাদিকতার উপর শিক্ষনবিশের কাজ পেল। এখন নাটা তার কাজকে খুব উপভোগ করে। তার কাজে অনেক পরিশ্রম করতে হয় তারপরও তার কোনো ক্লান্তি নেই। সে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করে। আস্তে আস্তে নাটা তার পেশায় সুনাম অর্জন করতে লাগলো।
নাটার মত হাজারো তরুণের সমস্যা রয়েছে। মন থেকে হতে চায় এক, পড়াশোনা আরেকটিতে আর কাজ করে ভিন্নটিতে। ফলে তার কাজ তার কাছে আনন্দময় হয় না। খুব দ্রুত ক্লান্তি ও বিরক্তি আসে। ভালো ফল বয়ে আনে না। মেধার প্রকৃত বিকাশ হয় না। অনেকে বছরের পর আপোস করে সময় পার করে। এর ফলাফল অতি ভয়াবহ। মনের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য অজান্তে বিভিন্ন মনো-দৈহিক রোগে আক্রান্ত হয় । এর ফলাফল এসে পড়ে পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে ও সমাজে।
সঠিক প্যাশন খোঁজে বের করতে পারলে অনেক উপকার আছে। এ বিষয়ে আমি ইকিগাই উল্লেখ করতে চাই। ইকিগাই একটি জাপানি ধারণা। এর সাধারণ অর্থ হলো হওয়ার কারণ। আপনার ইকিগাই হল আপনার জীবনের উদ্দেশ্য বা আপনার আনন্দের কারণ। এটিই আপনাকে আনন্দ দেয় এবং প্রতিদিন বিছানা থেকে উঠতে অনুপ্রাণিত করে। এর উপাদান চারটি।
- যা আপনি পছন্দ করেন।
- আপনি কিসে ভালো।
- কী কারণে আপনাকে সম্মানিত করা হয়।
- কোন জিনিসগুলি মানুষের প্রয়োজন রয়েছে।
জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপের অধিবাসীরা ইকিগাই খোঁজে বের করে কাজ করে। ফলে তারা সুখী জাতি এবং তাদের গড় আয়ু একশ বছরের উপরে। আপনার ইকিগাই যদি খোঁজে বের করতে পারেন, তাহলে আপনি সহজে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন।
এবার দেখুন, মোহাদি কী ভাবছে। মানুষের সঠিক প্যাশন খোঁজে বের করার জন্য কোন জায়গা থেকে মোহাদি কাজ শুরু করবে তার পরিকল্পনা করতে লাগলো। প্রথমে সে চিন্তা করলো শিক্ষা নিয়ে। সে ভাবলো এটাই প্রকৃত জায়গা, যেখানে ঠিকমত কাজ করতে পারলে অনেক বড় সমস্যার সমাধান করা যাবে। সে আরও ভাবলো মানুষ প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হলে সচেতন নাগরিক হবে। ফলে তারা নতুন সমস্যার জন্ম না দিয়ে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করবে। কিন্তু গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থায় তা সম্ভব নয়। এ শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষ কে উন্নত কেরাণী বানাতে বেশি ভালো। এখানে মেধার মূল্যায়ন না করে কাজ চাপিয়ে দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে প্রথমে একটি বড় ভুল রয়েছে, তা হল ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের সঠিক প্যাশন খোঁজে বের করা হয় না।
প্যাশন হল – মানুষ যে কাজ করতে কখনও ক্লান্ত হয় না বা কোন বিরোক্তি আসে না, সে কাজ খোঁজে বের করা। ছোটদের প্যাশন খোঁজে বের করা একটি বড় কাজ। মোহাদির ভাবনা হল – অভিভাবক ও শিক্ষকগণ বাচ্চাদের আগে প্যাশন খোঁজে বের করবেন। যে বাচ্চাগুলো যে দিকে প্রকৃত ভালো তার জীবনের লক্ষ্য সে দিকে ঠিক করে দিতে হবে। কোন বাচ্চাই মেধাহীন নয়। প্রত্যেকের কোনো না দিকে মেধা আছে। তাহলে সে বাচ্চাগুলো বড় হয়ে মূল্যবান মানুষ হবে। তারা সঠিক কাজ খোঁজে পাবে ও কাজ করে আনন্দ পাবে। তারা নতুন নতুন সমস্যার সমাধান করবে।
মানুষের সত্যিকারে ভালোলাগা কাজ বা প্যাশন খোঁজে বের করার জন্য মোহাদির প্রতিষ্ঠান একটি ডিজিটাল যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে। এ যন্ত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। মোহাদির এ যন্ত্রের নাম ইডুট্রেকার১ (এখানে কাল্পনিক নাম ব্যবহার করা হয়েছে) । এ যন্ত্র অভিভাবক ও শিক্ষকগণ ব্যবহার করে বাচ্চাদের পছন্দের কাজগুলি ট্র্যাক করতে পারবেন। এর মাধ্যমে বাচ্চাদের আগ্রহের কাজের সঠিক তথ্য বের করা সম্ভব। এর মোবাইল অ্যাপস রয়েছে, যা ব্যবহার করে যে কেউ তার প্যাশন খোঁজে বের করতে পারবে।
আরও পড়ুন: মোহাদি বিপদের শেষ নেই