মোহাদি দায়িত্বহীন মানুষ নয়। সে জানতো- যে দায়িত্বশীল সে সহজে সমস্যা সমাধান করতে পারে।
মোহাদির চাকরির বয়স মাত্র তিন মাস। এর মধ্যে সে দুই মাসের বেতন পেয়েছে। পুরোটাই খরচ হয়ে গেছে। প্রতি মাসে বেতন পেলেই সে নিজের থাকা-খাওয়া ও সামান্য হাত খরচের টাকা রেখে বাকি টাকা তার মাকে পাঠিয়ে দেয়। যেহেতু সে একা থাকে, তাই তার খরচ খুব বেশি নয়। তার বাসায় একটি মাত্র কক্ষ। তার কোন কাজের লোক নেই। সে নিজেই রান্না করা, কাপড় ধোয়া ও ঘর পরিষ্কার করার কাজ করত। সুতরাং তার বাড়তি খরচও ছিল না। সে যা বেতন পেত তা একজন মানুষের জন্য সব খরচ মিটানোর পর অর্ধেক টাকা জমা থাকার কথা। কিন্তু তা সম্ভব হতো না। কারণ তার উপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা অনেক।
বাবা, বাহারুল হক সরদার বেঁচে নেই। তিনি খুব ছোট বেসরকারী চাকরি করতেন। ছয় বছর আগে তিনি জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। টাকার অভাবে তিনি চিকিৎসা করাতে পারেন নি। তার মা, ইবাদুননেসা সংসারের সব দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পেশায় গৃহিণী। তার বড় ভাই, মোছাদ্দেক হোসেন একটি বেসরকারী চাকরি করেন। তিনি থাকা না থাকা সমান কথা। সংসারের কোনো দায়িত্ব নেন নি। তিনি বউ ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে আলাদা থাকেন। মেজ ভাই, মোজাক্কের বেক।র। পড়া শেষ করে পাঁচ বছর ধরে চাকরির চেষ্টা করে তিনি হতাশ।
বড় বোন, মোছাঃ মোরবিনা আক্তার বিবাহিতা। সে পেশায় গৃহিনী। সে পড়ালেখা বেশি করেনি। মাধ্যমিকের আগেই তার বিয়ে হয়। তার সংসার অভাবী। মোহাদির দুলাভাই, জব্বারুল ইসলাম উড়নচন্ডি টাইপের মানুষ। তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফন্দি করে চলেন। ধার-দেনা করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবসা শুরু করেন আর লোকসান করে বন্ধ করে দেন। তিনি মাথা গরম টাইপের লোক। কোনো কারণ ছাড়া মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন ঝামেলা করেন। ছোট বোন, মোমিতা হক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সে খুব মেধাবিনী। তার যে টাকা লাগে তা সে নিজেই উপার্জন করে। বৃত্তির আর টিউশানীর টাকা তার উপার্জনের উৎস। আর ছোট ভাই, মোসাব্বের কলেজের ছাত্র। সেও খুব প্রতিভাবান। সে নিজের পড়া নিজেই পড়ে। টাকার অভাবে শিক্ষকের কাছে কোচিং করতে পারে না। পরিবার থেকে শুধু কলেজের ফি দেওয়া হয়।
মোহাদি প্রতি মাসের ৫ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে বেতন পায়। ৩ তারিখ থেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে মোবাইলে কল আসতে থাকে। গ্রাম থেকে তার মা ফোন করেন সংসারের খরচের টাকার জন্য। মোহাদির দেওয়া টাকা ছাড়া তার কোন আয়ের উৎস নেই। আগে তিনি জমি থেকে কিছু ফসল পেতেন। এখন জমি বর্গা দেওয়া হয়েছে বলে জমি থেকে ফসল আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নিজেদের আধা-পাকা একটি বাড়ি থাকায় মাথা গোজার জায়গা আছে। এটা না থাকলে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোথায় যে থাকতেন তা ইবাদুননেসা জানেন না।
ছোট ভাই, মোসাব্বের কলেজের বেতন দিতে হয় মাসের মাঝা-মাঝি সময়ে। মোহাদির কাছে ছোট ভাইয়ের বাড়তি আবদার ছিল। প্রতি মাসেই সে মনে করিয়ে দেয়। সে আশা করে ছিল মোহাদি তাকে বেতনের টাকা দিয়ে একটি স্মার্টফোন কিনে দেয়।
বড় বোন মোরবিনা আক্তার কিছু টাকার জন্য ফোন করে। মোহাদির কাছ থেকে কিছু টাকা পেলে সংসারের প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে পারতো এবং ঋণ শোধ করতে পারতো। এতে তার স্বামীর কাছেও ভাল থাকতে পারতো। তার স্বামী তাকে বার বার টাকার জন্য চাপ দেয়, যাতে তার চাকরিজীবী ভাইয়েরা প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠায়।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছোট বোন, মোমিতা ফোন করে সামনে মাসে পরীক্ষার জন্য টিউশানী করতে পারছেনা। সেজন্য তার কাছে কিছু টাকা পাঠাতে বলে। আবার তার স্মার্ট ফোনও দরকার। থাকলে তার পড়া-লেখার উপকার হয়।
মেজ ভাই, মোজাক্কের বেকার হওয়ায় তার হাত একদম খালি । তার কিছু টাকা দরকার বলে মোহাদিকে ফোন করে।
বড় ভাই, মোছাদ্দেক হোসেনের ছেলে সাকু আর মেয়ে সঞ্চি সামনের ঈদে উপহার চেয়ে মোহাদিকে ফোন করে। কারণ তাদের চাচা নতুন চাকরি পেয়েছে।
মোহাদি চাকরি পেয়েছে বলে বাল্যকালের ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা খাওয়ার আশা করে ফোন করে। তাদের সাথে বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে আড্ডায় অংশ গ্রহণ করে না বলে অনেক অপমান সহ্য করতে হয় । তাদের কেউ কেউ বলে যে মোহাদি অসামাজিক, কৃপণ ও স্বার্থপর। কারণ মোহাদি তাদের জন্য খরচ করতে পারে না।
গ্রামের মসজিদ সংস্কার করা হচ্ছে। সুতরাং মসজিদ কমিটি ভাল পরিমাণ টাকার জন্য মোহাদিকে ফোন করে।
দুই-তিন মাস থেকে আনিতা চাপ সৃষ্টি করছে খুব দ্রুত বিয়ে করার জন্য। আনিতার সাথে মোহাদির পরিচয় প্রায় চার বছর আগে। চার বছর আগে তারা একটি সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয়। তারপর ক্রমান্বয়ে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। এখন বিয়ে না করলে আনিতার বাবা তাকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিবে। সে ভাল চাকরি করছে এটা আনিতা তার পরিবারকে জানিয়ে দিয়েছে। আনিতার চেয়ে বেশি অস্থির হয়েছে আনিতার ছোট বোন সুনিতা। বোনের বিয়ে হলে সে খুব বিয়ে করতে পারবে। কারণ সুনিতার যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে সে ছেলে সরকারী চাকরিজীবি। সুতরাং তাদের পরিবার সে সোনার হরিণ হাতছাড়া করতে চায় না। সে জন্য আন্তালেব চৌধুরী দুই মেয়ের বিয়ে এক সাথে আয়োজন করতে চায়।
চারদিক থেকে মোহাদি অনেক চাপের মধ্যে। অফিসের কাজ নিয়ে সারা দিন ব্যস্ত থাকার পর আবার এই পারিবারিক চাপ। কী করবে সে? সে কি সব দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যাবে, না সবার সাথে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাবে?
এসব কিছুই করলো না মোহাদি। সে দায়িত্বহীন মানুষ নয়। সে জানতো যে দায়িত্বশীল সে সহজে সমস্যা সমাধান করতে পারে।
মোহাদি ঠান্ডা মাথায় ভাবতে থাকলো। সে বিভিন্ন উপায় খোঁজার চেষ্টা করলো। চিন্তা করলো তার এ পরিস্থিতি নিয়ে কোন নির্ভরযোগ্য কারও কাছে শেয়ার করা দরকার। প্রথমে তার মায়ের সাথে আলোচনা করল। এরপর বড় ভাইকে বাস্তব অবস্থা জানালো। দু’জন নিজস্ব লোকের সাথে বর্তমান অবস্থা ভাগাভাগি করে সে কিছুটা হালকা হলো।
মোহাদি প্রথমে বড় ভাই মোছাদ্দেক হোসেনের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করলো। এটা শুরুতে খুব কঠিন ছিল । প্রথম বাধা আসে মোহাদির ভাবী মাবিয়া খাতুনের পক্ষ থেকে। তিনি সুন্দরী মহিলা কিন্তু দায়িত্বজ্ঞানহীন ও বোকা কিসিমের । মোহাদি সুযোগ বোঝে তার খুব প্রশংসা করলো। বিশেষ করে তার রূপের প্রশংসা। এতে ভদ্র মহিলা কিছুটা পরিবর্তন হলেন। ফলে মোহাদির তার ভাইয়ের পরিবারের মোটিমুটি ভাল সম্পর্ক তৈরি হল।
সামর্থ্য অনুসারে মোহাদিরা দু’ভাই পুরো পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হলো। তারা অতিরিক্ত খরচ এবারে না করতে সম্মত হলো। শুধু মাত্র অতি প্রয়োজনীয় খরচগুলি তালিকা করলো। এছাড়া আরও কিছু জরুরী কাজের তালিকা করলো। যেমন মেজ ভাই, মোজাক্কের ও বড় বোন, মোছাঃ মোরবিনা আক্তারের জন্য কোন কাজ খোঁজে বের করা। তাদের দু’জনকে এসএমই ফাউন্ডেশনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলো। তারা সেখানে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য তিন মাসের প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করলো।
মোহাদি আনিতার বিষয়টি এখনও কারও কাছে শেয়ার করেনি। আরও কয়েকদিন দিন সময় নিল। এরপর ছুটির দিনে আনিতার সাথে দেখা করলো। আনিতা কে কিছুটা সম্মত করতে সক্ষম হলো। আনিতা উচ্চ শিক্ষিতা এবং তার বুদ্ধির ঘাটতি নেই। সে খুব আবেগিক হলেও মোহাদির প্রতি আস্থাশীল। মোহাদি বিয়ে করার জন্য পাঁচ মাস সময় বাড়িয়ে নিল। আনিতা খুব খুশি না হলেও কিছুটা নিশ্চিত হয়ে বাসায় গেল।
চারদিকে অর্থের অভাব। মোহাদি কীভাবে তার পরিবারকে বিয়ের কথা বলবে? বিয়ে করতে তো অনেক খরচের ব্যাপার!
মোহাদি কয়েকদিন ভাবলো বিষয়টি নিয়ে। আবার সে আনিতাকে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। অবশেষে সে তার মেন্টরের সাথে দেখা করলো। মেন্টরকে সে আনিতার বিষয়টি বিস্তারিত বর্ণনা করলো। মেন্টর সাহেব অনেক বাস্তববাদী লোক এবং তাঁর ফাইন্যানসিয়্যাল আইকিউ খুব উন্নত । তিনি বিষয়টি বুঝতে বেশি সময় নিলেন না। তিনি মোহাদিকে বললেন প্রতিশ্রুতি অনুসারেই বিয়ে করতে বললেন। কিন্তু কোন বড় আয়োজন না করতে বললেন। খুব সংক্ষিপ্তভাবে বিয়ে সম্পন্ন করতে উপদেশ দিলেন। আরও বললেন কোনভাবেই যেন বিয়েতে বেশি খরচ না হয় এবং এজন্য যেন কোন ঋণ করা না হয়। মোহাদির মেন্টরের চিন্তা মতে বিবাহে বেশি খরচ করা এক ধরনের দায়। আর ঋণ করে বেশি খরচ করা আরও বড় দায়। এর নেতিবাচক প্রভাব একটি নতুন সংসারে দীর্ঘদিন থাকে।
পরবর্তী অধ্যায়: মিতব্যয়ী মোহাদি উন্নতির দিকে