দেশের অনেক সমস্যা সমাধানের জন্য মোহাদির উদ্ভাবনগুলির খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। এই উদ্ভাবনগুলির ধারণা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে অনেক সাহসী তরুণ নতুন প্রকল্প তৈরি করতে লাগলো। অনেকেই সফল হলো। এটা দেখে অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা মোহাদির খোঁজ-খবর করতে লাগলো। কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান মোহাদিকে তাদের প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসেবে কাজ করতে অনুরোধ করলো। মোহাদির উদ্ভাবনী ধারণাগুলির খবর সরকারী সংস্থার চোখ এড়ালো না। অনেক সুবিধাবাদী মানুষ তার সাথে খাতির করতে লাগলো। মোহাদির খবরে একজন উচ্চ পদে চাকরি করা সরকারী কর্মকর্তা, জনাব কবির হোসেন জোয়াদ্দার সাহেবের (কাল্পনিক নাম) নজরেও পড়লো । পাঠক হয়ত ভাবছেন, তিনি মোহাদির কাছে থেকে ভালো উদ্ভাবনী ধারণা নিয়ে নিজের নামে চালিয়ে দেবেন। ফলে তার দপ্তরে তার সুনাম হবে এবং প্রমোশন পাওয়া সহজ হবে। ফলে উপার্জন করা তার পক্ষে আরও সহজ হবে। হয়ত ঠিক অথবা ঠিক না। জানতে শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
কবির হোসেন জোয়াদ্দার সাহেবের উদ্দেশ্যই অসৎ। তার কাজ হলো একটার পর একটা অজুহাত বের করে নিজের পকেট ভারী করা। ভুয়া ডকুমেন্ট তৈরি করতে তিনি খুব দক্ষ। অসৎভাবে টাকা উপার্জন করা তার নেশা। তিনি যেমন উপার্জন করেন, তেমন তার খরচ। তার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে মিলে ইচ্ছামতো খরচ করে। তার স্ত্রীর এক মাসের বিউটি পার্লারের খরচ দিয়ে আমার মত সাধারণ মানুষের সারা মাসের বাজার খরচ চলবে। তাকে প্রতি মাসে ব্যাংককে যেতে হয় স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য। আর সাজগোজ করতে যান সিঙ্গাপুরে। শুনেছি মিসেস কবিরের নামে ভিন্ন দেশের কথিত বেগম পাড়ায় বাড়িও তৈরি করা হয়েছে। সেই বাড়িতে থেকে তার ছেলে পড়ালেখা করছে।
ছেলেকে বিদেশে পড়ানোর জন্য মাসে খরচ হয় ২০ থেকে ২৫ লক্ষ ট।কা। এ খরচ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি। খাবার, পোশাক-আশাক ও চলাফেরার খরচ যে কত সেটা কবির সাহেবই বলতে পারবেন। আর মেয়ে পড়ে একটি নামী-দামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। তার জন্য সার্বক্ষণিক একজন সহকারী ও ড্রাইভারসহ গাড়ি লাগে। তার জন্য বাসায় গৃহ শিক্ষক রাখা হয়েছে মোট ৫ জন। গণিতের জন্য একজন, বিজ্ঞানের জন্য দুইজন, ভাষার জন্য একজন ও অন্যান্য বিষয়ের জন্য একজন। গণিতের শিক্ষক সপ্তাহে তিন দিন দুই ঘন্টা করে পড়ান। এর জন্য মাসিক বেতন পান পঁচিশ হাজার টাকা। তারপরও ভদ্রলোক সন্তুষ্ট না। কারণ ছাত্রীর জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। মাঝে মধ্যে সে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বের হয়। আড্ডার পর সময় বাঁচলে শিক্ষকের কাছে পড়ে। এর উপর ঘন ঘন রুটিন পরিবর্তন করে। অত্যধিক ধৈর্যশীল শিক্ষক ছাড়া কবির সাহেবের মেয়েকে পড়াতে পারেন না । সব মিলিয়ে মেয়ের প্রতি খরচ কত তা বলা মুশকিল।
কথিত আছে, গাড়ির খরচ নাকি হাতির খরচ। আমি একটি গাড়ির খরচ সামলাতে অস্থির হয়ে যাই। তার উপর ড্রাইভার নেই। কিন্তু কবির সাহেব কীভাবে চারটি গাড়ির খরচ মিটান? কী জানি, কীভাবে পারেন? তারপর আবার বছর বছর গাড়ির মডেল পরিবর্তন করেন। না করলে তার স্ত্রী তার বন্ধুদের কাছে মুখ দেখাতে পারেন না।
কবির জোয়াদ্দার সাহেবের আবার একটি শখ আছে। তিনি প্রতি সপ্তাহে গলফ খেলতে যান। তিনি যে গলফ ক্লাবের সদস্য সেখানে চাঁদা দিয়েছেন প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা। এর মাধ্যমে তিনি আজীবন সদস্য হয়েছেন। তিনি সপ্তাহে একদিন গলফ খেলে রাতে রিসোর্টে বিনোদন করেন। আমি শুনেছি তিনি নাকি ঐ রিসোর্টের ৫০ শতাংশ অংশিদার। রাতে বিনোদনের সব রকম ব্যবস্থা থাকে। বিভিন্ন রঙের পানি গ্রহণ করেন। সেগুলোর নাম আমি জানি না এবং জানার আগ্রহও নেই। আরেকটি গোপন তথ্য হলো জোয়াদ্দার সাহেব জুয়াখেলায় সেরা। বেশির ভাগ সময় তিনি জিতেন।
জোয়াদ্দার সাহেবের এত টাকা তিনি একা উপার্জন করেন না। তার বিশাল একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। অনেক বড় বড় অবৈধ লেনদেন হয় এই দলের মাধ্যমে। ছোট কর্মকর্তা, বড় কর্মকর্তা, কিছু নেতাও তার দলের সদস্য। আর পালের গোদা হলেন জোয়াদ্দার সাহেব। মোহাদির উদ্ভাবিত প্রযুক্তি প্লেক্সাস তাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। দুর্নীতির ধরা খাওয়ার ভয়ে জোয়াদ্দার সাহেব মোহাদির কাছে একটি চুক্তি করতে এসেছেন। তিনি চান এ প্রযুক্তি অন্যদের তথ্য প্রকাশ করুক, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু জোয়াদ্দার সাহেবের দলের কাউকে যেন ট্র্যাক না করে। তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে মোহাদির অফিসে হাজির হয়ে প্রকাশ করলেন। এর বিনিময়ে বড় অংকের টাকা অফার করলেন। মোহাদি সরল মনে তার কথা শুনলো। কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। মোহাদি জোয়াদ্দার সাহেবকে কী জবাব দিয়েছিল তা জানবেন পরবর্তী কোনো লেখায়।
মোহাদির উদ্ভাবনী ধারণার খবর পেয়ে অনেকে তাকে ইমেইল করলো। অসংখ্য মেসেজ আসলো ম্যাসেঞ্জার ইনবক্সে। সবাই তাদের সমস্যার সমাধান জানতে চায়। কারও নিজস্ব সমস্যা, কারও পারিবারিক সমস্যা বা কারও অফিসিয়াল বা সামাজিক সমস্যা। তবে সমস্যাগুলোর বেশির ভাগই অর্থ উপার্জন সংক্রান্ত।
সাদমান নামের একজন সমাধান চেয়েছে। সে লিখেছে – তার কাছে ৩ লক্ষ টাকা আছে, কোন ব্যবসা করলে মাসে ১ লক্ষ টাকা লাভ হবে? এটা ছিল শিরোনাম। বিস্তারিত অংশে সে বিশদভাবে লিখেছে। সাদমান পড়ালেখা শেষ করেছে। এখনও কোনো চাকরির ব্যবস্থা করতে পারে নি। অনেক চেষ্টা করে মনস্থির করেছে- ব্যবসা করবে। এদিকে তার বান্ধবীও তাকে বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছে। কোনো সম্মানজনক কাজ বা চাকরি না করলে সে বিয়ে করতে পারছে না। ৩ লক্ষ টাকা তার বাবা-মাকে অনুরোধ করে ব্যবস্থা করতে পারবে। তাকে পড়াতে গিয়ে তার পরিবার সব সম্পদ শেষ করেছে। এখন এই টাকাই একমাত্র সম্বল। মায়ের ৩ লক্ষ টাকার একটি ডিপিএস ছিল। তিনি এটি রেখেছিলেন তার ছোট মেয়ের জন্য। যদি কোনো ভালো ব্যবসা করে মাসে ১ লক্ষের কাছাকাছি টাকা উপার্জন করতে পারে, তাহলে সাদমানের সম্মান বাঁচে। তাকে মোহাদি কী উপদেশ দিয়েছিল তা পাবেন পরবর্তী গল্পে।
আর একজন ভদ্রলোক মোহাদিকে ইমেল করেছেন, ম্যাসেঞ্জারে ইনবক্স করেছেন এবং খোঁজতে খোঁজতে মোহাদির অফিসে হাজির। তিনি অনেক দিন থেকে হন্যে হয়ে মোহাদিকে খোঁজ করছেন। ভদ্রলোকের নাম মাহতাব। মোহাদি সময় করে তার কথা শুনার জন্য রাজি হলো। খুব ধৈর্য্য ধরে তার কথা শুনলো।
মাহতাব সাহেব একটি ছোট ব্যবসা করেন। উপার্জন মোটামুটি ভালোই। খুব পরিশ্রম করেন। তিনি বাড়তি কোনো খরচ করেন না। তার কোনো মদ্যপান বা ধুমপানের মত কোনো বদ অভ্যাস নেই। প্রয়োজন ছাড়া তিনি কোথাও আড্ডাবাজি করেন না। তার শখ একটাই। তা হলো প্রতিদিন দুইবেলা বিশ্ব সংবাদ শোনা। এটা যেন তার নেশা। কিন্তু এতে তার তেমন কোনো খরচ হয় না বা ক্ষতি হয় না। বরং উপকারই হয়। তার এই নেশা তার স্ত্রীর পছন্দ নয়। প্রতিদিনই গালমন্দ করেন। এ ব্যাপারে মাহতাব সাহেব কিছু মনে করেন না। তার অভিযোগ অন্য বিষয় নিয়ে।
প্রতিদিনের বাসার খরচের টাকা মাহতাব সাহেব হিসাব করে দেন। যেহেতু উপার্জন সীমিত, সুতরাং হিসাব করে খরচ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। তার স্ত্রীর এটা পছন্দ নয়। তিনি হিসাব সংসারের খরচ করতে চান না। এতে তার সম্মানে লাগে। তার মনে যেটা চাইবে সেটা খেতে পছন্দ করেন। ডাক্তার তাকে লাল মাংস, আইসক্রিম, ভাজা-পোড়া খাবার ও মিষ্টি খেতে বারণ করেছেন। তিনি এগুলো শুনতে নারাজ। কিন্তু ঔষধ খেতে কোনো বাধা নেই। তিনি রুটিন করে তিন বেলা ঘুমান। ঘুম হচ্ছে তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। গড়ে দিনে ১২-১৬ ঘন্টা শুয়ে কাটিয়ে দেন। দিনের বাকি সময় কাটান টিভি দেখে আর মোবাইলে কথা বলে। তিন জনের সংসারে প্রতি মাসে যত টাকা বাজার খরচ হয় তার দ্বিগুণ খরচ হয় বউয়ের ঔষধ আর মোবাইল বিলের জন্য। মাহতাব সাহেব এ ব্যাপারে সরাসরি কিছু না বললেও মনে মনে খুব কষ্ট পান। খাবারের নিয়ম-কানুন ও স্বাস্থ্যবিধি তার বউকে শেখাতে অনেক কষ্ট করেছেন, কোনো লাভ হয়নি।
মাহতাব সাহেব নিজে অনেক সাধনা করেন উন্নতি করার কিন্তু সব সময় আর্থিক টানা টানির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সুতরাং তিনি কীভাবে আরও উপার্জন করতে পারেন যাতে সংসারে ইচ্ছামত খরচ করতে পারেন। এর জন্য তিনি উদ্ভাবনী কোনো ভালো ধারণা ও উপদেশ মোহাদির কাছে আশা করেন। পরবর্তীতে মোহাদির উপদেশে মাহতাব সাহেবের খুব কাজে লেগেছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে পরের গল্পে।
এখানে মাত্র তিনটি প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করলাম। আরও যে সমস্ত প্রশ্ন রয়েছে, মোহাদি সিরিজের যেকোনো অংশে প্রাসঙ্গিক হলে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ। সুতরাং চোখ রাখুন মোহাদি সিরিজে। হয়ত আপনার বা আপনার পরিচিতজনদের কাজেও লাগতে পারে।
পড়ুন: মোহাদির সমস্যা সমাধান কৌশল অন্যরকম