মোহাদির আলাদা একটি স্বপ্ন আছে। চাকরি করা তার প্যাশন না। সে চাকরি করছে দু’টি কারণে।
- প্রথম কারণ: “দক্ষতার উন্নয়ন।”
- দ্বিতীয় কারণ: “স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কিছুটা টাকা উপার্জন।”
মোহাদি ধীরে ধীরে দক্ষতা অর্জন আর কিছু টাকা সঞ্চয় করতে চায়। সে জন্য সে যতদিন চাকরি করবে ততদিন অফিসের কাজে তার অত্যধিক পেশাদার মনোভাব নিয়ে কাজ করছে। যে কোনো কাজ সে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে করে। এ পর্যন্ত সে একদিনও অনুপস্থিত থাকে নি। সে বেশি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে। খুব দ্রুত সে উন্নতি করতে থাকে। অনেকেই তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আবার অনেকে তার সাফল্যে তার উপর ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। অফিসে তার বিভাগে সে মধ্যম স্তরের কর্মকর্তা হওয়ায় তাকে ঊর্ধ্বতন ও জুনিয়রদের সাথে সমন্বয় করে কাজ করতে হতো। বাধা যে কম আসতো তা নয়। মোহাদি খুব দক্ষ হাতে সব বাধা মোকাবেলা করে অফিসের উন্নতির জন্য কাজ করতো।
মোহাদি যে বিভাগে কাজ করে সেখানে প্রধান ব্যক্তি জনাব সুজাতুল হোসেন একজন বয়স্ক ব্যক্তি। তিনি যতটা না কাজে দক্ষ তার চেয়ে লবিং আর তেল মারতে খুব দক্ষ। তার উপর তিনি মালিক পক্ষের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। অফিসে তার অবস্থান বছরের পর বছর টিকিয়ে রেখেছেন চতুরতার মাধ্যমে। তিনি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কথায় কথায় তেল মর্দন করেন। সব কথায় হ্যাঁ বলেন এবং কোনো যুক্তি তিনি তেমন খোঁজেন না। আবার তার অধিনস্থদের সঙ্গে অতিরিক্ত পরিমাণে গল্প করেন। যে কাজ এক কথায় শেষ করা যায় তা একশ কথায়ও শেষ করতে পারেন না।
বসের ব্যাপারে মোহাদি খুব অবগত। অতিকথা পছন্দ না হলেও মানিয়ে চলে। কোনো কাজে তার কাছে যাওয়া মানে দু’ঘণ্টা তার প্যাচাল শোনা। কী আর করার? না শুনলে আবার কোন দোষ ধরবে! মোহাদি ব্যাপারটি শিখে নিয়েছে। সে খুব ভালো শ্রোতা। সে জানতো কী করে অতিরিক্ত কথা বলা মানুষকে আয়ত্ব করতে হয়। পুরো মনোযোগ দিয়ে সে বসের কথা সব শুনত। বসের কথার মাঝখানে কোনো বিরক্ত করতো না। কোনো শিক্ষনীয় বিষয় পেলে মাথা নেড়ে সায় দিতো। মোহাদি বসের চোখের দিকে তাকিয়ে সব কথা শুনতো। তিনি যা বলেন তা কল্পনা করার চেষ্টা করতো। বসের গল্পের মধ্যে অনেক আনন্দ ও দুঃখের বিষয় আসলে মোহাদি উপযুক্ত এমপ্যাথি দেখাতো। এতে বস আরো খুশি হতো। সব কিছু মিলে বস মোহাদির উপর খুশি।
জনাব সুজাতুল হোসেন বেশিরভাগ সময় কথা বলতেন তার অতীত ও বংশ মর্যাদা নিয়ে। তিনি একজন উচ্চশিক্ষিত এবং তিনি ভালো বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন এসব নিয়ে বার বার সবার সাথে গল্প করতেন। আরও বলতেন তার ছেলে ও মেয়ের সাফল্যের গল্প। তার বাবা অনেকদিন আগে এমপি ইলেকশানে নমিনেইশান পেয়েছিলেন। এটা তার প্রত্যেক সহকর্মীদের কয়েক শত বার করে বলেছেন। তিনি কীভাবে বিয়ে করেছেন এটা সবাইকে বলেছেন কয়েক ডজন বার করে। তার ছেলে সরকারি চাকরি কীভাবে পেয়েছে এটা তো সবার মুখস্হ।
জনাব রাগিব মোহাদির এক স্তর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি মোহাদির বসের প্যাচাল একদম সহ্য করতে পারেন না। মোহাদির বসও তাকে খুব পছন্দ করেন না। বস মোহাদিকে রাগিবের স্থলে বসাতে চান। এটার জন্য সুজাতুল হোসেন সাহেব তার উপর মোহলে রিপোর্ট দিয়েছেন। এটা রাগিব জেনেছেন। জানার পর মোহাদির সাথে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করেছেন। মোহাদি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে এর গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করলো। কাউকে কোনো অভিযোগ করে নি। অন্য কারও সাথে এ বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা করলো না। সে গভীরভাবে ভাবতে লাগলো কীভাবে এ সমস্যা সমাধান করা যায়। মোহাদির জন্য এটা বড় সমস্যা। আগে এ ধরনের জটিল সমস্যায় পড়ে নি। কিন্তু সে যেকোনো সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত।
রাগিব খুব দক্ষ কর্মকর্তা। তার কাজের ব্যাপারে কেউ কোনো ত্রুটি ধরতে পারে না। কিন্তু তিনি খুব রাগী মানুষ। রেগে গেলে তাঁর কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মোহাদির উপর তাঁর খুব রাগ। সে অত্যন্ত রাগান্বিত থাকার কারণে ভুলভাবে চিন্তা করলেন। ভাবলেন মোহাদিকে সরিয়ে দিতে পারলে তাঁর অবস্থান স্থায়ী হয়। এ কারণে সে সব বদ ধরনের চিন্তা করতে লাগলেন।
মোহাদিকে সরানোর জন্য রাগিব সন্ত্রাসী ভাড়া করলেন। সন্ত্রাসীরা মোহাদিকে একা রাস্তায় পেয়ে খুব ভয়-ভীতি দেখালো। তারা তাকে এ অফিস ছেড়ে যেতে বললো। মোহাদি এতে খুব ভয় না পেলেও সতর্ক থাকলো। এ বিষয়টি সে আনিতার সাথে শেয়ার করে নি। কিন্তু রাতে বাসায় ফিরে এ থেকে রক্ষা পাবার বিভিন্ন উপায় খুঁজতে লাগলো। সুতরাং সে কয়েক দিন ধরে রাতে বাসায় ফিরে বেশিরভাগ সময় চুপচাপ থাকতো। আনিতা মোহাদির পরিবর্তন লক্ষ্য করলো কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলো না।
রাগিব ভাড়াটিয়ে সন্ত্রাসীদের দ্বারা মোহাদিকে অফিস থেকে ব্যর্থ হয়ে আরো খারাপ ও বিপদজনক পথ অবলম্বন করলেন।মোহাদির সংসার ভাঙ্গার জন্য পরিকল্পনা করলেন। সেজন্য টাকার বিনিময়ে একজন খারাপ ধরনের যুবতী মেয়ে ঠিক করলেন।সে মেয়ে আনিতার কাছে গিয়ে মোহাদির চরিত্র নিয়ে অনেক উল্টাপাল্টা কথা বললো, যা তাকে রাগিব শিখিয়ে দিয়েছিলো।সে আনিতাকে জানালো যে প্রতিদিন অফিস শেষে মোহাদি তাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, ভালো জায়গায় খাওয়ায় ও বিভিন্ন কিছু কিনে দেয়।রাগিবের কথামতো মোবাইলে কিছু ছবিও দেখালো।যদিও ছবিগুলো এডিট করা ছিলো।মেয়েটা দেখতে সুন্দর কিন্তু পোশাক-আশাকে খুব সভ্য মনে হলো না আনিতার কাছে। সে প্রথমে মেয়েটার কথা বিশ্বাস করে নি। কিন্তু ছবি দেখার পর তার মনে অবিশ্বাসের বীজ অঙ্কুরিত হলো। সে আরও ভাবলো অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক করার কারণে মোহাদি কয়েকদিন থেকে বাসায় তেমন কথা বলে না।এরপর আনিতা আরও অনেক উল্টাপাল্টা ঋণাত্মক চিন্তা করতে লাগলো।
এমনিতে অফিসের বিষয় নিয়ে মোহাদির মন খারাপ। তার উপর আনিতার সন্দেহ। তার মানসিক চাপ অনেক বেড়ে গেল। রাতে বাসায় ফিরে দুইজনের কিছু কথা কাটাকাটি হলো। না খেয়ে তারা ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে ঘুম থেকে উঠে আনিতা তার বোনের বাসায় চলে গেলো। মোহাদি তাকে না যেতে অনুরোধ করলো কিন্তু জোর করলো না। সে জানে আনিতা খুব আবেগিক হলেও খুব ভালো মেয়ে। হয়তো কয়েকদিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে। এরপর রেডি হয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য নিচে নামলো। নিচে নেমে বাড়ির দারোয়ানকে বলতে শুনলো, “ছিছিছি ঘরে এতো সুন্দর এচটা বউ রেখে একটা বাজে মেয়ের পাল্লায় পড়েছে”। দারোয়ান আরও যোগ করলো: “বাহির থেকে ভালো মানুষ হলেও ভিতর থেকে ভালো কিনা তা বোঝা মুশকিল”।
দারোয়ানের কথায় মন খারাপ হলেও কোনো কিছু বললো না। সোজা অফিসে চলে গেলো। অফিসে গিয়ে দেখে রাগিব খুব খোশমেজাজে আছে। তার খোশমেজাজের কারণ বুঝতে মোহাদির সময় লাগলো না। এটা নিয়ে না ভেবে সে কাজে মন দিলো। কিন্তু সে খুব স্বস্তিতে কাজ করতে পারলো না। কয়েকবার আনিতাকে ফোন করলো, কিন্তু সে রিসীভ করলো না।
কোনো রকমে অফিস শেষ করে সে দিন একটু আগে অফিস থেকে বের হলো। সাধারণত সে বাসে যাতায়াত করে। ঐদিন বাসে না উঠে থ্রিহুইলারে বাসায় যাবে বলে মনস্থির করলো। অফিসের কাছে থ্রিহুইলার পেয়ে গেলো। চালক সহজে রাজি হয়ে গেলো। বড় রাস্তায় ধরে আসছিলো। বিপরীত দিক থেকে এক বাস হঠাৎ থ্রিহুইলারটিকে সামনের দিকে ধাক্কা দিলো। থ্রিহুইলারের সামনের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত। চালকের মাথায় ও হাতে আঘাত লাগলো। ভাগ্য ভালো মোহাদির কিছু হয়নি। সে চালককে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করলো এবং থ্রিহুইলারের কাগজ ঘেটে এর মালিককে খবর দিলো।
মোহাদি সারারাত হাসপাতালে কাটিয়ে দিলো। গুরুতর আহত চালকের নিজস্ব লোকের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাত যে কখন শেষ হয়ে গেল সে বুঝতে পারে নি। সকালে ঐ চালকের একমাত্র মেয়ে আসলো। মোহাদি তাকে বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় গেলো। বাসায় গিয়ে গোসল করেই আবার অফিসে গেলো। অফিসেই নাস্তা করে নিলো। সে খুব ক্লান্ত। শরীর, মন কোনটিই ভালো নেই।
অফিসের জরুরী কাজ শেষ করে মোহাদি হাসপাতাল হয়ে বাসায় গেল। তার একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার। বাসায় গিয়ে দেখলো আনিতা বাসায় এসেছে। আনিতাকে দেখে সে খুব খুশি হলো। আনিতাই আগে তার সাথে কথা বললো। সে মোহাদির জন্য দুঃখ প্রকাশ করলো। তারপর মোহাদি আনিতার মুখে সব ঘটনা শুনলো।
মেয়েটি মোহাদির বিরুদ্ধে যে খুব গুরুতর ও সংবেদনশীল অভিযোগ করেছিলো তা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা আর বানোয়াট। রাগিব তাকে টাকার বিনিময়ে বলতে বাধ্য করেছিলো। মেয়েটির বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো আর সারারাত জেগে সেবা করা দেখে মেয়েটির ভুল ভেঙ্গে যায়। এরপর সে আনিতাকে বিস্তারিত বলে মাফ চায়। ফলে আনিতার ভুল ভাঙ্গে। মেয়েটি শেষে একটি ভালো ও সাহসী কাজ করেছিলো। মোহাদির জন্য রাগিবের খারাপ উদ্দেশ্য অফিসে ও পুলিশকে লিখিতভাবে জানায়। এমন অপরাধের জন্য কিছুদিনের মধ্যে রাগিবের চাকরি চলে যায় এবং পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
শিক্ষা:
অন্যায় ধ্বংস হয়ে যায় আর ন্যায় টিকে থাকে।
পরবর্তী অধ্যায়:মোহাদির নতুন উদ্যোগ