গত লেখায় মোহাদির কাছে যে তিনটি সমস্যা এসেছিল এখানে সেগুলির সমাধান জানতে পারবেন। মোহাদি সংক্ষিপ্তভাবে কোনো সমাধান দেয় না। সে যেকোনো সমস্যা পেলে আগে তা বিস্তারিতভাবে ভেবে তার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান খুঁজে বের করে। প্রথমে আসি সে মাহতাব সাহেবের সমস্যার কী সমাধান দিয়েছিল ।
মাহতাব সাহেবের স্ত্রীর প্রধান সমস্যা ছিল জীবনধারা এবং খাদ্যাভ্যাস । অনেক বিখ্যাত চিকিৎসকের পরামর্শেও কাজ হয়নি। মোহাদি মাহতাব সাহেবকে প্রথমে উপদেশ দিয়েছিল যে তার স্ত্রীকে জীবনধারা এবং খাদ্যাভ্যাস (lifestyle and food habit) বিষয়ে কিছু জ্ঞান অর্জন করতে। যেহেতু একটি মন্দ লাইফ স্টাইলে ছোটকাল থেকে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, সুতরাং ছোট খাটো উপদেশে কাজ হবে না। এর গভীরে যেতে হবে। মোহাদির পরামর্শ অনুসারে ভালো জীবনধারা এবং খাদ্যাভ্যাস বিষয়ে কোনো লেখা বা ভিডিও পেলেই তার বউয়ের ম্যাসেঞ্জারে বা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেন। প্রথম প্রথম সাইনা আক্তার (মাহতাব সাহেবের স্ত্রী) তার স্বামীর উপর খুব রাগ করতেন। কিন্তু মাহতাব সাহেব হাল ছাড়লেন না।
মাহতাব সাহেব মাঝে মাঝে ভালো জীবনধারা এবং খাদ্যাভ্যাস বিষয়ে কোনো ভালো বই কিনে আনতেন। স্ত্রীকে সরাসরি পড়তে বলতেন না, কারণ তিনি রেগে যেতে পারেন। মাহতাব সাহেব জানতেন ভোগ্য পণ্য ছাড়া কোনো জ্ঞানের সামগ্রী সাইনা আক্তারের পছন্দ ছিলো না। এজন্য কোনো বই তার ধারে কাছে কোথাও রাখতেন, যাতে নজর পড়ে। সময় পেলে নিজেও পড়তেন। আর প্রাসঙ্গিক লেখাগুলি ইনবক্স করা চালিয়ে যেতে থাকলেন। খাওয়ার টেবিলে সময়মত ভালো লাইফ স্টাইলের সুবিধা নিয়ে আলোচনা করতেন। এভাবে কয়েক মাসের চেষ্টায় সাইনা আক্তারের মন নরম হলো। তিনি ভালো লাইফ স্টাইলের মানসম্পন্ন বই, ভিডিও, আর্টিকেল ও টিভি অনুষ্ঠানে পছন্দ করতে লাগলেন। এ সুযোগে মাহতাব সাহেব স্ত্রীকে একটি উন্নত ইয়োগা সেন্টারে ভর্তি করালেন।
কয়েক মাসের মধ্যে সাইনা আক্তারের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হতে লাগলো। তিনি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠা শুরু করলেন। খাবারের মেনু পরিবর্তন হতে লাগলো। ওজন নিয়ন্ত্রণে আসল। তার চিন্তার ধরণ পরিবর্তন আসলো। কথায় কথায় তিনি আর রাগ করেন না। তিনি মোটামুটি পরিবর্তিত হয়ে গেলেন। তার বন্ধুদেরকে ভালো লাইফ স্টাইলের জন্য অনুপ্রাণিত করতে লাগলেন। ঔষধের খরচ কমে আসলো। অস্বাস্থ্যকর খাবারের অপ্রয়োজনীয় খরচ কমে গেল। দুইজন কাজের বুয়া কমিয়ে একজন রাখলেন। তার টিভি দেখা ও মোবাইলে কথা বলা কমে গেল। তার বেশির ভাগ সময় কাটতে লাগলো সংসারের কাজ করে, বাচ্চার দেখাশোনা করে আর বই পড়ে। এমনকি তিনি স্বামীকে বললেন ড্রাইভার ছেড়ে দিয়ে নিজের কাজ নিজে করতে। বউয়ের আমুল পরিবর্তনে মাহতাব সাহেব খুব খুশি। এখন তার একই পরিমাণ উপার্জনে সংসারের সব খরচ চালিয়ে কিছু সঞ্চয় হয়। অথচ আগে ঠিকমত সংসার চলতো না ।
মাহতাব সাহেব বউয়ের উপর খুব খুশি। মোহাদির কাছে পরামর্শ নিতে যাওয়ার আগে কত কিছুই চিন্তা করেছিলেন। তিনি অনেক ঘনিষ্ট বন্ধদের সাথেও আলোচনা করেছিলেন। কেউ বলেছিলেন এমনিই সব ঠিক হয়ে যাবে, কেউ বলেছিলেন ভালো ডাক্তার দেখাতে আবার কেউ বলেছিলেন দরবেশের কাছে নিতে। একজন বন্ধু একটি ভয়ঙ্কর উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি মাহতাব সাহেবকে বলেছিলেন আর একটি বিয়ে করতে। তার বন্ধুর লজিক হলো-আরকটি বউ থাকলে প্রথমটির ঢং এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি নিজেও অনেক নেগেটিভ চিন্তা করেছিলেন। নেগেটিভ চিন্তা করলেও বার বার শুধু ডাক্তারের কাছে নিয়েছিলেন।
মোহাদির কাছে পরামর্শ নেওয়ার আগে মাহতাব সাহেব সংক্ষিপ্তভাবে ও তাড়াতাড়ি সমাধান খুঁজছিলেন। আসলে সংক্ষিপ্তভাবে কোনো জটিল সমস্যা সমাধান করা যায় না। এরজন্য সমস্যার গভীরে গিয়ে সব ধাপ অবলম্বন করে আস্তে আস্তে অগ্রসর হলে অনেক কঠিন সমস্যা সমাধান করা যায়।
এবার জানুন মোহাদি কীভাবে সাদমান নামে সেই যুবকের সমস্যার সমাধান দিয়েছিল। সাদমান চেয়েছিল খুব দ্রুত ও সংক্ষিপ্তভাবে ৩ লক্ষ টাকা পুঁজি খাটিয়ে মাসে এক লক্ষ টাকা উপার্জন করতে। আসলে বৈধভাবে কখনই তা সম্ভব নয়। প্রথমে মোহাদি সাদমান কে ভালোভাবে জানার চেষ্টা করলো। তার পড়াশোনা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করলো।
সাদমান স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করলেও তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নেই। মোহাদি তাকে প্রথমে দক্ষতা জানতে চাইলে সে বলেছিল সে বিবিএ পাশ। আসলে বিবিএ পাশ কোনো দক্ষতা নয়। এটা হলো তার শিক্ষার সনদ বা ডিগ্রী। মোহাদি তাকে আবার প্রশ্ন করে কোন কাজ তার ভালো লাগে এবং সেই কাজে কোনো ক্লান্ত আসে না। সাদমান বলেছিল, “আমার বন্ধুদের সাথে সারাদিন গল্প করতে ও ঘুরে বেড়াতে কোনো বিরুক্তি বা ক্লান্তি নেই ।”
মোহাদি দেখলো সাদমান অনেক অপরিপক্ক মানুষ। সে বিবিএ শেষ করেছে ঠিকই কিন্তু কোনো বাস্তব জ্ঞান নেই। সে আরো বলেছিল, “টাকা উপার্জন করার ভালো উপায় না পেলে দুইটি মোটরবাইক কিনে একটি সে রাইডশেয়ারিং সার্ভিস দিবো আর অন্যটি আমার বন্ধু পিনুর কাছে ভাড়া দিবো। পিনু বলেছে দুইজন মিলে সারাদিন বাইক চালালে লাখখানিক টাকা উপার্জন হবে।” পিনু তার ছোট বেলার বন্ধু। তেমন পড়া-লেখা করেনি। তিন বার চেষ্টা করেও মাধ্যমিক পার হতে পারে নি। সে সবসময় রংচটা ও ছেড়া-ফাটা জিন্স পরে। তার মাথার চুল দুই ধরনের রং করা। তাকে দেখতে আজব দেখায়। সে কোনো কাজ কর্ম করে না। তার প্রধান কাজ গলির মোড়ে আড্ডা দেওয়া।
সাদমানের চিন্তা খুব খারাপ না। কিন্তু এটি অতি সংক্ষিপ্ত আর ভয়ঙ্কর। মোহাদি এটা সাপোর্ট করে না। একজন শিক্ষিত মানুষ আরো ভালো ও ফলদায়ক কাজ করতে পারে। মোহাদি সাদমানকে বলেছিল, “তোমার মায়ের ডিপিএস ভাঙ্গার দরকার নেই। দেখি আমি কোনো উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।” সে লক্ষ্য করলো সাদমান খুব ভালোভাবে গুছিয়ে কথা বলতে পারে, ভালো বাইক চালাতে পারে আর কম্পিউটারের জ্ঞান মোটামুটি ভালো। তার উপর এইসব সে খুব উপভোগ করে।
মোহাদি সাদমানের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে তার সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানলো। শেষে তাকে পরামর্শ দিলো, “তুমি ভ্লগিং শুরু করো।” সাদমান ভ্লগিং সম্পর্কে তেমন কিছু জানতো না। মোহাদি এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করলো। সব শুনে সাদমানের চোখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। সে আরো জানতে চাইলো, “কত টাকা লাগবে এ কাজ শুরু করতে।“ মোহাদি জানালো যে শুরুতে কোনো টাকাই লাগবে না। মোবাইল দিয়েই কাছের কোনো দর্শনীয় জায়গায় গিয়ে ভিডিও করে ইউটিউবে আপলোড করতে পারবে। পরে আস্তে আস্তে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনলেই চলবে।
সাদমান খুব আগ্রহ নিয়ে ও মনোযোগ সহকারে কাজ শুরু করলো। কয়েক মাসের মধ্যে তার ইউটিউব চ্যানেলের সাবক্রাইবার হাজার অতিক্রম করলো। মানুষ তার চ্যানেল পছন্দ করতে শুরু করলো। সেও খুব আনন্দিত। প্রতি সপ্তাহে একটি করে ভিডিও তৈরি করতে থাকলো। একটু একটু করে উপার্জন হতে লাগলো। সে এবার তার ভ্লগিং টিম তৈরি করলো। কোনো টাকা ছাড়াই পিনু সহায়তা করতে লাগলো। তার বান্ধবী, জিনিয়া তাকে ভিডিও এডিট করতে ও প্রচারে সহায়তা করতে লাগলো।
এক বছর যেতে না যেতে সাদমান নিজের উপার্জিত টাকা দিয়ে বাইক ও কম্পিউটার কিনলো। এরপর সংসারেও কিছুটা অবদান রাখতে শুরু করলো। অনেক তরুণের কাছে সাদমান একজন পথিকৃৎ (Role Model) হয়ে উঠলো। তার কাজে স্বাধীনতা থাকায় সে জীবনকে খুব উপভোগ করতে লাগলো।
এবার দেখুন কীভাবে মোহাদি কবির হোসেন জোয়াদ্দার সাহেব নিয়ে যে সমস্যায় পড়েছিল তা সমাধান করলো। জোয়াদ্দার সাহেব একজন জটিল মানুষ। আগেই বলেছি তার নেটওয়ার্ক অনেক বিস্তৃত। মোহাদি মহা মুশকিলে পড়লো, কীভাবে এই জটিল পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া যায়? তার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেলো। গভীরভাবে ভাবতে লাগলো এ সমস্যা সমাধানের জন্য। জোয়াদ্দার সাহেব বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে হুমকি দিতে শুরু করলো। প্রশাসন ও রাজনীতির দুই-একজন লোক মোহাদিকে ভয়-ভীতি দেখালো। তাকে গুম করে দেওয়ার হুমকি দিলো।
মোহাদি আতঙ্কিত হলেও ভীত ছিলো না। সে যেকোনো সমস্যার গভীরে গিয়ে এর দীর্ঘমেয়াদী সমাধান খোঁজ করে। এ ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতাও অনেক। প্রথমে সে নিজে চেষ্টা করে, না পারলে দুই একজনের সাথে শেয়ার করে। তার এই সমস্যা নিয়ে প্রথমে শেয়ার করলো তার ঘনিষ্ট কিছু বন্ধুর সাথে। একজন বলেছিল সব ছেড়ে বিদেশ চলে যেতে। আর একজন বললো জোয়াদ্দার সাহেবের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দিতে। কিন্তু মোহাদির পছন্দ হলো না। সে ভিন্নভাবে সমাধান বের করার চেষ্টা করতে লাগলো।
জোয়াদ্দার সাহেবের সমস্যা নিয়ে যখন মোহাদি অস্থির তখন সে একটি খবর পেল যে জোয়াদ্দার সাহেবকে দুদক তলব করেছে। সে মনে করলো এতে তার (জোয়াদ্দার সাহেবের) তেমন কিছু হবে না। কারণ তার নেটওয়ার্ক সব জায়গায়। দুদকের লোকদের কিনে ফেলা তার পক্ষে কঠিন কাজ নয়। দুদক তলব করার ফলে মোহাদির একটি সুবিধা হলো যে তার বিরুদ্ধে হুমকি-ধামকি আসা সাময়িক বন্ধ হলো।
দুদক জোয়াদ্দার সাহেব কে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার অবৈধ টাকার উৎস বের করার চেষ্টা করলেন। ফলে তিনি খুব ঝামেলায় পড়লেন। পুরোপরিবার দেশ ত্যাগ করার চেষ্টা করলেন। তার স্ত্রী ও মেয়ে যেতে পারলেও তিনি পারলেন না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় ইমিগ্রেশন তাকে আটকিয়ে দিয়েছে। তিনি খুব চিন্তায় পড়লেন এবং টেনশন করতে লাগলেন। তার নেটওয়ার্কের অন্যরা গা ঢাকা দিলো। বিপদের সময় কেউ তার কাছে থাকলো না। বিশেষ করে ক্ষমতাশালীরা তার ব্যাপারে কোনো মুখ খুললেন না। তারা ভাবলেন জোয়াদ্দার সাহেব ডিলিট হলে তারাও বাঁচেন।
যারা জোয়াদ্দার সাহেবের অন্যায় উপার্জনের ভাগ নিতেন, তারা তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন। ফলে তিনি একরকম বিপদেই পড়লেন। দুশ্চিন্তা, টেনশন আর ক্লান্তি তাকে জেঁকে বসলো। তার আগে থেকেই হার্টের সমস্যা ছিল, সেটা আরো বেড়ে গেল। এর মধ্যে আর একটি বিপদ ঘটলো। তিনি গাড়ি দূর্ঘটনায় পড়লেন। তিনি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। তার পরিবারের কোনো সদস্য তার পাশে নেই। আস্তে আস্তে তার অবস্থার অবনতি হলো। কয়েক মাসের মধ্যে মোহাদি খবর পেলো জোয়াদ্দার সাহেব আর নেই। মোহাদি ঝামেলা থেকে বেঁচে গেলেও জোয়াদ্দার সাহেবের জন্য তার মন খুব খারাপ হলো।
জোয়াদ্দার সাহেবের মৃত্যুর পর তার নেটওয়ার্কের কেউ আর মোহাদিকে উত্যক্ত করে নি। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই সে একটি বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেল।
চলবে