এই লেখাটিতে ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সাধারণ ধারণা দেওয়া হয়েছে। যাদের অর্থের সাথে সম্পর্কিত বিষয় সমূহে উচ্চতর ডিগ্রী নেই, তাদের জন্য এই লেখাটি খুব উপকার দেবে।
এই লেখাটি দু’টি গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই। গল্প দু’টি নেওয়া হয়েছে একই বিষয়ে, একই প্রতিষ্ঠানে ও একই সাথে পড়া-লেখা করা দুই জন বন্ধুর। এক জনের ফাইন্যান্সিয়াল ব্যাসিক ভালো এবং অন্য জনের ভালো না।
গল্প#১: আসিফের ব্যক্তিগত ফাইন্যান্সিয়াল জ্ঞান ভালো না।
যখন আসিফ স্নাতক শেষ বর্ষে পড়ত, তার কিছু ঋণ করতে হয়েছিল। এটা তার প্রথম ঋণ ছিল না। একাদশ শ্রেণী থেকেই ঋণের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। এসব ঋণ সব পরিশোধ করবে চাকরির বেতন দিয়ে। বরাবরই সে খুব পরিশ্রমী ও ভালো ছাত্র ছিল। সুতরাং ঋণ পেতে সুবিধা হত। সে খুব অনিয়ম করত সে কারণে মাঝে মাঝে অসুস্থ থাকত। আর এজন্যও তার খরচ একটু বেশি ছিল। আবার তার অনেক বন্ধু-বান্ধব থাকায় তার হাত খরচও বেশি হত। রেজাল্ট ভালো করে বলে তার পরিবার তাকে ঋণ করে টাকা দিতে কখনও দেরি করে না।
স্নাতক শেষে আসিফ প্রায় এক বছরের মত বেকার ছিল। চাকরির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে তার আবার ঋণের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। তার পরিবারের স্থায়ী সম্পদ বন্ধ রেখে তার পরিবারই বার বার ঋণের ব্যবস্থা করে দিত। যেহেতু তার পরিচিত লোকজন বেশি ছিল তাই একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে একটি ভালো চাকরি পেয়েছিল। বেতনও ভালো ছিল। তার নিজের খরচ, ঋণের কিস্তি বাদে তার তেমন সঞ্চয় থাকত না। কারণ তার বিলাশী দ্রব্যের প্রতি খুব আকর্ষণ ছিল। চার বছর চাকরি করে খুব সামান্য সঞ্চয় নিয়ে বেশি আয়োজন করে বিয়ে করতে গিয়ে আবার ঋণ করে আসিফ। এদিকে আগের ঋণের কিস্তি তখনও শেষ হয়নি। আবার ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেও ঋণ করে অদরকারী জিনিসপত্র কিনত। এরপর নতুন করে গাড়ির ঋণের ভার যুক্ত হয়েছে। এভাবে স্নাতক হওয়ার বার বছর পর আর প্রায় এগার বছর চাকরি করেও ঋণের জাল থেকে মুক্ত হতে পারে নি। চাকরির এগার বছর মেয়াদে তার বেতন দ্বিগুণের বেশি হওয়ার পরও তার কোন সঞ্চয় নেই এবং অর্থনৈতিক টানাটানির মধ্যে দিয়ে চলতে হচ্ছে।
গল্প#২: মানিকের ব্যক্তিগত ফাইন্যান্সিয়াল জ্ঞান ভালো।
যখন মানিক স্নাতক শেষ বর্ষে পড়ত, সে ফ্রিল্যান্সিং করে নিজে চলত এবং সামান্য পরিমাণ সঞ্চয় করত। পরিবারের উপর তার জন্য অর্থনৈতিক চাপ ছিল না। ফ্রিল্যান্সিং করার কারণে মানিকের যে দক্ষতা অর্জিত হয়েছিল সেজন্য সে স্নাতক শেষ করার পরই মোটামুটি মানের একটি চাকরি পেয়েছিল। বেতন খুব খারাপ ছিল না। যেহেতু সে মিতব্যয়ী জীবন যাপন করত, সে কারণে সব খরচ বাদে তার ভালো পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় হত। সে বিয়ে করেছিল সাধারণ আয়োজনের মধ্যে। ফলে তার অতিরিক্ত খরচ হয়নি। সংসারে সাধারণ মানের আসবাবপত্র ব্যবহার করত। তার কোন ক্রেডিট কার্ড ছিল না। তার ছিল ডেবিট কার্ড। তার কখনও ঋণ করতে হয়নি। চাকরির পাঁচ বছর পর মোটামুটি অভিজ্ঞতা ও অর্থ সঞ্চয় অর্জন করার পর মানিক উদ্যোক্তা হওয়ার কাজে নামে। কাজের প্রতি ভালোলাগা, একনিষ্ঠতা, সততা, কঠোর পরিশ্রম ও মিতব্যয়ীতার গুণে মানিক স্নাতক পাশ করার বার বছরের মধ্যে হয়েছে একজন সফল উদ্যোক্তা ।
প্রথম গল্পে আসিফের ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনা বা ব্যক্তিগত ফাইন্যান্সিয়াল শিক্ষা সম্পর্কে সাধারণ ধারণা ভালো নয়। আর দ্বিতীয় গল্পে মানিকের ধারণা খুব ভালো। হয়ত সে ছোটবেলা থেকে তার পরিবার থেকে অথবা বই পড়ে নিজের জীবনে চর্চা করতে করতে এ দক্ষতা অর্জন করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মানিক এ শিক্ষা লাভ করে নি। কারণ আসিফ এ শিক্ষার বিন্দু মাত্র অর্জন করতে পারে নি। যদিও তারা শুরু থেকে স্নাতক পর্যন্ত একই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছিল।
এখন প্রশ্ন হল ব্যক্তিগত ফাইন্যান্সিয়াল শিক্ষা কী?
ব্যক্তিগত সব সম্পদ একত্র করা ও ভালো আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনা। ব্যক্তিগত আর্থিক সিদ্ধান্তের মধ্যে আয়, বাজেট, সঞ্চয়, ঋণ, বিনিয়োগ, বিনিয়োগ থেকে উপার্জন, ট্যাক্স, ভ্যাট, স্টক, বন্ড, মর্টগেজ, অর্থ বিষয়ক ঝুঁকি, ব্যাংকিং ইত্যাদি জড়িত। এর প্রভাব আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রচুর। ব্যক্তিগত অর্থ বিষয়ক ভালো পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করার জন্য আর্থিক জ্ঞান দরকার।
ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনা বোঝতে হলে প্রথমে জানতে হবে সম্পদ (Asset) ও দায় (Liability) সম্পর্কে। যে খাত সমূহ থেকে অর্থ আসে সেগুলো হল সম্পদ। আর যে খাত সমূহ থেকে অর্থ বের হয়ে যায় সেগুলো হল দায়। যাদের এ ব্যাসিক জ্ঞান আছে, তারা অতিরিক্ত খরচ করেন না। তাদের অর্থ বিষয়ক জ্ঞান বা ফাইন্যান্সিয়াল আই কিউ ভালো।
এবিষয়ে খুব সহজ করে বর্ণনা করেছেন বিখ্যাত আমেরিকান লেখক ও উদ্যোক্তা রবার্ট কিয়োসাকি তাঁর বহুল বিক্রিত ‘রিচ ড্যাড পু’র ড্যাড’ বইয়ে। তিনি বলেছেন,
ক্রেডিট কার্ড একটি দায় ও ঋণ করে এ্যাপার্টমেন্ট কেনা দায় (Liability)।
ব্যক্তিগত ফাইন্যান্সিয়াল শিক্ষার গুরুত্ব:
ব্যক্তিগত অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ ধারণা না থাকার কারণে অনেকে তাদের নিজস্ব সম্পদ ঠিক মত ব্যবস্থাপনা করতে পারেন না। ফলে তারা আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হন। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, ৯০% মানুষের অর্থ বিষয়ক সাধারণ শিক্ষা খুব দূর্বল। তারা অর্থকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেন। তারা মনে করেন বেশি টাকা থাকলে মানুষ বিপথে যায়। তারা এটাও বলেন যে,
“অর্থই অনর্থের মূল”।
অথচ টাকা না থাকলে বা কম থাকলে আর্থিক স্বাধীনতাই থাকে না। যখন তাদের ছেলেমেয়েরা প্রয়োজনীয় টাকা চায়, তখন দিতে পারে তো পারে না, উল্টো বকা দেয় এই বলে যে,
“টাকা কী গাছে ধরে?”
যারা চাকরি বা ছোট ব্যবসা করেন অথবা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ রক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সাধারণ ধারণা থাকা আবশ্যক। এটা না থাকার কারণে তারা ট্যাক্স উকিল নিয়োগ করেন। এটি একটি বাড়তি খরচ। কেউ যখন নিজে ভালো না বোঝেন, ট্যাক্স উকিল সাত-পাঁচ বুঝিয়ে বিভিন্ন ধান্ধা করেন। আর কেউ যদি নিজে ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান লাভ করেন, তখন এ জ্ঞান ব্যবহার করে নিজের সম্পদ রক্ষা করার পাশাপাশি আরো বাড়াতে পারবেন।
আর্থিক বুদ্ধিমত্ত্বা না থাকার কারণে অনেকে অপ্রয়োজনীয় ঋণ করেন। ঋণের ভার বহন করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকে জেল বসে কষ্টের জীবন অতিবাহিত করছেন।
আর্থিক বুদ্ধিমত্ত্বা না থাকার কারণে অনেকে ভুল জায়গায় বিনিয়োগ করে করেন। লাভ তো হয়ই না উল্টো পুঁজি হারিয়ে ব্যবসার লালবাতি জালিয়ে দেয়।
ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যারা দক্ষ, তারা বলেছেন-
“যারা লটারী জিতে ধনী হয়, তাদের ৭০% ই কিছু দিনের মধ্য দেউলিয়া হয়ে যায়।“ এ কারণ এবার আপনিই ভাবুন।
ব্যক্তিগত ফাইন্যান্সিয়াল শিক্ষা থাকার ফলাফল:
আপনি আর্থিক বুদ্ধিমত্ত্বা বা ফাইন্যান্সিয়াল আই কিউ অর্জন করতে পারলে, বেশি উপার্জন, খরচ কমিয়ে বেশি সঞ্চয় এবং ভালো জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারবেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন নিচের লিংক থেকে:
বেশি উপার্জন, কম খরচ এবং ভালো জায়গায় বেশি বিনিয়োগ
আপনি অর্থ বিষয়ক সঠিক পরিকল্পনা ও সুষম বাজেট তৈরি করতে পারবেন। অর্থের জন্য অন্য ব্যক্তির উপর নির্ভর করতে হবে না। ফলে ফাইন্যান্সিয়াল ফ্রিডম লাভ করতে পারবেন।
উপসংহার:
উপরের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আলোচনা করলে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন খুব দরকারি বিষয়। ছাত্র-ছাত্রী, পেশাজীবী, গৃহকর্তী, বেকার, উদ্যোক্তা সকলের এধরনের জ্ঞান থাকা একান্ত দরকার। অথচ এ ধরনের শিক্ষা কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয় না। আপনি যদি এ ধরনের জ্ঞান অর্জন করতে চান, তাহলে প্রাসঙ্গিক বই পড়তে পারেন, ভিডিও দেখতে পারেন অথবা কোন ব্যক্তিগত ফাইন্যান্স বিষয়ে দক্ষ লোকের পরামর্শ নিতে পারেন।
টাকা উপার্জন সংক্রান্ত অন্যান্য ব্লগ:
টাকা ছাড়া শুরু করে কীভাবে ধনী হওয়া যায়?
কীভাবে একটি স্টার্টআপ তৈরি করার মাধ্যমে প্রচুর টাকা উপার্জন করা যায়?
কীভাবে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে আপনি ধনী হবেন?
কোন সম্পদগুলো মানুষকে ধনী করে?
যে দক্ষতা গুলো আপনাকে ধনী করবে।
১০টি সেরা বই, যেগুলো আপনাকে ধনী হতে সাহায্য করবে।
গ্রামে বসে কী কী ব্যবসা করা যায়?